অনলাইন ডেস্ক:
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পেছনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার মুখে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ দফা ‘সুরক্ষা নির্দেশনা’ জারি হয়েছে গত সোমবার। এরপর দুই দিন ধরে আলোচনা চলছে এসব নির্দেশনা কিভাবে কতটা পালন হবে, কার্যকর করার দায়দায়িত্ব কার থাকবে। আগে যেকোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সবাই মূলত তাকিয়ে ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের দিকে। আর দায়িত্ব পালন নিয়ে অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের এক ধরনের ঠেলাঠেলি অবস্থা ছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নির্দেশনাগুলো সঠিক মাত্রায় কার্যকর হয়নি বা আশানুরূপ সাফল্য মেলেনি।
সেদিকে নজর রেখেই এবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে, যেখানে ১৮ দফা নির্দেশনার মধ্যে ১০টিই কার্যকর করার দায়িত্ব পড়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। কমপক্ষে ১০টি মন্ত্রণালয় সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে। মন্ত্রণালয়গুলো হচ্ছে জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, সড়ক, নৌপরিবহন, বিমান, শিল্প ও বাণিজ্য এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়। আবার কয়েকটি নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে সমন্বিতভাবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই বেশি দায়িত্ব পড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় যার যার সেক্টরের জন্য প্রযোজ্য নির্দেশনাগুলো কার্যকর করবে।
উচ্চ ঝুঁকিতে ২৯ জেলা
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেশের ২৯টি জেলাকে করোনা সংক্রমণের তিনটি ক্যাটাগরিতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে উচ্চ ঝুঁকির ছয় জেলা ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর; মধ্যম থেকে উচ্চ ঝুঁকির ১৯ জেলা মৌলভীবাজার, সিলেট, নরসিংদী, রাজবাড়ী, ফেনী, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, রাজশাহী, নড়াইল, নীলফামারী, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, নওগাঁ, রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল; কম ঝুঁকি থেকে উচ্চ ঝুঁকির পাঁচ জেলা নোয়াখালী, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর ও নাটোর।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত সোমবারের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ এ ছাড়া ‘সিদ্ধান্তসমূহ অবিলম্বে সারা দেশে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপাতত দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন,‘আপনারা দেখেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বাস চলাচল নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। রেল মন্ত্রণালয় রেলের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আগামীকাল (আজ বুধবার) থেকে অর্ধেক জনবল নিয়ে অফিস করবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে চাইবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাঠ প্রশাসন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকার জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাই এ বিষয়ে সব দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আশা করি অতীতের মতো করোনার এই ধাক্কাও আমরা সামাল দিতে পারব।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সরকারের দেওয়া নির্দেশনা সবাইকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। যদি কেউ এই নির্দেশনা না মানে তবে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে; মহামারিসংক্রান্ত আইনেই সেই এখতিয়ার সরকারকে দেওয়া আছে।’
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জারিকৃত নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, ‘সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক/রাজনৈতিক/ ধর্মীয়/অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমণযুক্ত এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলো। বিয়ে/জন্মদিনসহ যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে; মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে; পর্যটন/বিনোদনকেন্দ্র, সিনেমা হল/থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে; গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না; সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আন্ত জেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে; বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক (হোটেলে নিজ খরচে) কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী খোলা/উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনপূর্বক ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; ওষুধের দোকানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে; স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মাস্ক পরিধানসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে; শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদরাসা, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়) ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে; অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা/আড্ডা বন্ধ করতে হবে।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরিধানসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক পরিধান না করলে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; করোনায় আক্রান্ত/করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যদেরও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে; জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান শিল্প-কারখানাগুলো ৫০ শতাংশ জনবল দ্বারা পরিচালনা করতে হবে। গর্ভবতী/অসুস্থ/বয়স ৫৫-ঊর্ধ্ব কর্মকর্তা/কর্মচারীর বাড়িতে অবস্থান করে কর্মসম্পাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে; সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে; সশরীরে উপস্থিত হতে হয় এমন যেকোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে; হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে; কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবস্থানকালীন সর্বদা বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
এসব নির্দেশনার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, যে কোনোভাবে আমরা সংক্রমণ প্রতিরোধের দিকে যেতে চাই। নয়তো সামনে আরো বড় বিপদ দেখতে হতে পারে। এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো আমরা আমাদের অবস্থান মতো কার্যকর করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যান্য বিভাগের ভূমিকা পালন করা জরুরি। কারণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অন্য বিভাগগুলোর মাঠ পর্যায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানুষকে সচেতন করা, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, টিকাদান, চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলো যতটা সম্ভব নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি। কিন্তু যদি সামাজিকভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা না যায় তবে শুধু টিকা দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে মানুষের সুরক্ষা মিলবে না।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে তা সব জেলায় ও এলাকায় প্রশাসনকে অবহিত করব। এর বাইরে পরীক্ষা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও টিকার বিষয়ে জোরালো কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ৫-৬ এপ্রিল পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে, ৮ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজ শুরু হবে। দ্বিতীয় ডোজের শুরু থেকে কয়েক দিন হয়তো প্রথম ডোজ বন্ধ থাকতে পারে দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করার গুরুত্ব বিবেচনায়। পরবর্তী সময়ে আবার প্রথম ডোজও শুরু হবে দ্বিতীয় ডোজের পাশাপাশি।