অনলাইন ডেস্ক:
জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব, একেকটা ঘটনার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন একটি লক্ষ্য নিয়ে। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অগ্রগামী বাহিনী। জাতীয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যা বলতে পারতেন না, ছাত্রলীগকে দিয়ে সেটা বলাতেন।
আজকাল অনেকে অনেক কথা বলেন, অনেক কিছু লেখেন। ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, এগুলো বঙ্গবন্ধুর নির্ধারণ করে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু হয়নি। ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গীত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় সংগীত। এই সম্মেলনের শেষ দিন পল্টন ময়দানে জনসভার শুরুতে এই গান পরিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ছয় দফা বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ। ’ তারপর ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন। এই নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে কি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম? নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭০-এর ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর-২ অনুযায়ী লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার বা সংক্ষেপে এলএফও জারি হয়। সর্বমোট ৪৮টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এই এলএফওতে ৬ ও ১১ দফার দুটি দফা ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার’ এবং ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব’ মেনে নেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পাই ১৬৯টি আসন। কিন্তু ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন, সে জন্য ইয়াহিয়া খান এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নম্বর দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন।
২৫ নম্বর অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, ‘শাসনতন্ত্রের প্রমাণীকরণ’। যাতে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় পরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র বিল প্রমাণীকরণের জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট উপস্থাপিত হবে। এ পর্বে প্রমাণীকরণে প্রত্যাখ্যাত হলে জাতীয় পরিষদের অবস্থান লুপ্ত হবে। ’ আর ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল, ‘আদেশের সংশোধন এবং ব্যাখ্যা, ইত্যাদি’; এর ক-ধারায় ছিল, ‘এই আদেশের কোনো আইনের ধারা সম্পর্কে কোনো ধারণা, কোনো ব্যাখ্যা বা কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। ’ একই অনুচ্ছেদের খ-ধারায় ছিল, ‘জাতীয় পরিষদ নয়, বরং রাষ্ট্রপতিই এই আদেশের সংশোধনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। ’
এলএফওতে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। যার জন্য অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচন করে কোনো লাভ নেই। ’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার এই নির্বাচন ক্ষমতায় যাওয়ার নির্বাচন নয়। এই নির্বাচন হলো গণভোট এবং নির্বাচনের পরপরই আমি এই এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো। ’ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর ছিল প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন।
আমরা সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি আর প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮টি আসনে জয়লাভ করি। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠান। এই শপথ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছয় দফাকে তিনি আপসহীন অবস্থায় উন্নীত করেন।
এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। ৭ই মার্চ একদিনে আসেনি। ধাপে ধাপে এসেছে। এই ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। সব সময় সতর্ক ছিলেন, যাতে তিনি আক্রমণকারী না হয়ে আক্রান্ত হন। আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে যত্নবান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে কেউ যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে না পারে সে জন্য তিনি সতর্কতার সঙ্গে বক্তৃতা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একটি অলিখিত বক্তৃতা তিনি দিলেন বিশ্বাসী অন্তর থেকে।
বক্তৃতার শেষে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ অর্থাত্ সামগ্রিকতায় জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার ভারসাম্যপূর্ণ বক্তৃতা। এটিই মানুষ প্রত্যাশা করেছিল।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি, তবে দেখব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। কী বিচক্ষণ একজন নেতা! একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় এড়িয়ে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
৭ই মার্চের দুনিয়া কাঁপানো বক্তৃতা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চলার পথের দিকনির্দেশনা—যা আমরা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছি। আজ ঐতিহাসিক এই ভাষণ জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক দিগন্তে বাঙালির গৌরবময় পতাকা মর্যাদার সঙ্গে উড্ডীন রেখেছে। ২০১৭-এর ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো ’৭১-এর ৭ই মার্চে প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যেও (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের এবং আনন্দের।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি