অনলাইন ডেস্ক:
গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে দৈনিক করোনা শনাক্ত রোগীর হার ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে; এই হার ৫ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত ‘লকডাউন’ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সে অনুযায়ী সরকার গতকাল রবিবার এক প্রজ্ঞাপনে লকডাউনের আদলে চলমান বিধি-নিষেধ আরো এক সপ্তাহ অর্থাৎ ৬ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলবে। একই সঙ্গে সীমান্ত আগামী ১৪ জুন পর্যন্ত বন্ধ (জরুরি যাতায়াত ছাড়া) রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সীমান্তবর্তীসহ বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনমতো লকডাউন বা কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো কোনো সমুদ্রবন্দর হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পণ্যবাহী নৌযানের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ফলে সেদিকেও নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক সভা শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেছেন, বিদেশগামীদের জন্য টিকায় অগ্রাধিকার এবং ভাড়া কমানোর ব্যাপারে সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। আর আইইডিসিআর জানিয়েছে, দেশে চারটি দেশের করোনার ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।
এক সপ্তাহ বাড়ল লকডাউন : গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলামের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের সব বিধি-নিষেধের মেয়াদ ৩০ মে মধ্যরাত থেকে ৬ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগে আন্ত জেলা বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার অনুমতি দিয়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চলমান বিধিনিষেধের মেয়াদ গত ২৩ মে থেকে এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ৩০ মে মধ্যরাত পর্যন্ত করা হয়েছিল। করোনা মহামারি বিস্তারের ঊর্ধ্বগতি রোধে কঠোর বিধিনিষেধের দ্বিতীয় ধাপে ৫ এপ্রিল থেকে সীমিত আকারের বিধিনিষেধ চালু করে সরকার। এরপর এই বিধিনিষেধের মাত্রা কম-বেশি হয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে ঢিলেঢালা অবস্থায় চলছে। জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি অফিস আগের মতোই বন্ধ আছে। সেই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্র, সভা-সমাবেশ বন্ধ রয়েছে।
আরো সাত জেলায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের সুপারিশ
সরকারের পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সীমান্তবর্তী যেসব এলাকায় সংক্রমন বেড়েছে, সেই জেলাগুলোতে এখনই পূর্ণাঙ্গ লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন। সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধ জারির পর স্বাস্থ্যবিভাগ আরো যে সাতটি জেলাকে সর্বাত্মক লকডাউনের আওতায় নেওয়ার সুপারিশ করেছে সেগুলো হলো—নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর-রশীদ এবং সিভিল সার্জন ডা. এবিএম আবু হানিফ জানিয়েছেন, দেশের যে সাতটি জেলাকে সর্বাত্মক লকডাউনের আওতায় নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে নওগাঁ রয়েছে।
খুলনায় গতকাল পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, খুলনায় গেল এপ্রিল মাসের তুলনায় সংক্রমণ কমেছে। ওই সময়ে শনাক্তের হার ২৩ শতাংশ থাকলেও এখন তা ২০ শতাংশ।
যশোরেও স্থানীয় প্রশাসন আগের তুলনায় নজরদারি বাড়িয়েছে। সাতক্ষীরায় বাড়ছে সংক্রমণ। হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। ভারত থেকেও মানুষের যাতায়াত বেড়েছে।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়িক সংগঠনের সভাপতি আরাফাত হোসেন জানান, ভারত থেকে মালামাল নিয়ে কাজে ট্রাক চালক, হেলপার, খালাসী আসছে। তাদের নির্ধারিত বৃত্তের বাইরে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। ১৩৮ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অবৈধ পথে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে কমবেশি মানুষ বাংলাদেশে আসা যাওয়া করছে। সংক্রমন রোধে সাতক্ষীরায় লকডাউন ঘোষণা করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
সীমান্ত বন্ধ ১৪ জুন পর্যন্ত
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতে করোনা প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ভারতের সঙ্গে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম দফায় সব স্থল সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর আরও দুই দফায় ৩০ মে পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, সর্বশেষ গত শনিবার সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ আরও এক দফা বাড়ানো হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর পরে পূর্বের মতোই ভারতে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করা বাংলাদেশি নাগরিক, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে, তাদের ফিরতে হলে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন। অনুমতির জন্য সেখানের বাংলাদেশ মিশনে আবেদন করতে হবে।
নৌপথে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা
এদিকে মোংলার নদী পথে কমপক্ষে সাড়ে ৪ বা ৫শ কার্গো ভারতে নিয়মিত যাতায়াত করছে। ওই সব কার্গোতে চলাচলকারী ক্রু বা নাবিকদের মাধ্যমেও বাংলাদেশে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশংঙ্কা রয়েছে। ওই নৌযানগুলো ভারত থেকে পণ্য নিয়ে মোংলা হয়ে বরিশাল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ভৈরব ও আশুগঞ্জ নদী বন্দরে যাতায়াত করছে।
যদিও ওই সব নাবিকেরা যাতে মোংলা বন্দরে ল্যান্ড করতে না পারে এ জন্য ইতোমধ্যে মোংলায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার। তিনি বলেন, এজন্য কোস্টগার্ড নৌ পুলিশ ও বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মোংলায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ৩০ মে থেকে ৮দিনের কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। গত শনিবার ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড, যেখানে ৪২ জনের মধ্যে ৩১ জনই শনাক্ত হয়েছেন। যা শতকরা আক্রান্তের হার ৭৩.৮০ ভাগ।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, এই মুহূর্তে কঠোর লকলাউনের কোনো বিকল্প নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার বলেন, প্রবেশ সংকুচিত ও সীমিত থাকবে, জরুরী পরিবহণ ব্যতীত কোনো যানবাহন ঢুকবে না, বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে। ওষুধ ও জরুরি কৃষিপণ্য ব্যতীত সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে। কাঁচা ও মুদি বাজার, মাংস, মাছ ও ফলের দোকান প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। অন্য এলাকা থেকে বিভিন্ন নৌযানে আসা কেউ পৌর এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।
দেশে মিলেছে চার দেশের ভ্যারিয়েন্ট, স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন জানিয়েছেন, চলতি বছরে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ শুরুর পর থেকে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ২৬৩টি নমূনার সিকোয়েন্সিং হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনের নমুনায় ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, ৮৫ জনের নমুনায় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, পাঁচ জনের নমুনায় নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এবং ২৩ জনের নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ভ্যারিয়েন্ট নতুন কোনো বিষয় না। যত রোগী শনাক্ত হবে, সংক্রমণ হবে, ততই নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ভ্যারিয়েন্ট যা-ই হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি একইভাবে মেনে চলতে হবে এবং টিকা নিতে হবে।
আইইডিসিআরের পরিচালক সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়ে বলেন, এখন আমের মৌসুম চলছে। সীমান্ত এলাকার অনেক স্থানেই আমের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা চলছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাগান থেকে আম কেনা-বেচা নিশ্চিত করতে হবে। সীমিতভাবে এসব ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে এবং যতটা সম্ভব অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে আম কেনা-বেচা নিশ্চিত করতে পারলে ভাল সুফল পাওয়া যাবে।