সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
দীর্ঘপ্রতিক্ষার পর উদ্বোধন হলো সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম সেতু সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কুশিয়ারা নদীর ওপরে নির্মিত রাণীগঞ্জ সেতু। দক্ষিণা দুয়ার খুলে যাওযায় হাওরাঞ্চলের যোগাযোগে দিগন্ত যাত্রা শুরু হলো।
সোমবার (৭ নভেম্বর) সকাল ১১ টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালী এর উদ্বোধন করেন।
রাণীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ ৩ আসনের এমপি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের সঞ্চালনায় উদ্বোধনস্থলে উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মোশারফ হোসেন, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দীন আহম্মেদ, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত, জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকমল হোসেন প্রমুখ।
সুনামগঞ্জের সঙ্গে ভার্চুয়ালী যুক্ত প্রধানমন্ত্রী বাউল আব্দুল করিমের একটি লিখিত গান ও স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা উপভোগ করেন।
১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭০২ মিটার দীর্ঘ ও সাড়ে দশ মিটার প্রস্থের এই সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব কমে আসবে ৫৫ কিলোমিটার। এ কারণে আগে যেখানে সাড়ে ছয় ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছাতে হতো, সেখানে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
এছাড়া সেতুটি চালু হওয়ায় সুনামগঞ্জ থেকে দুই ঘণ্টায় পৌঁছা যাবে হবিগঞ্জে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় এই সেতু চালু হলে হাওরবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। একইসঙ্গে ফেরিমুক্ত হবে সুনামগঞ্জ।
সড়ক ও জনপথ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাগলা-জগন্নাথপুর-রাণীগঞ্জ- আউশকান্দি মহাসড়কের রাণীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ওপর রাণীগঞ্জ পিসি গার্ডার ও বক্স গার্ডার সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭০২ মিটার দীর্ঘ ও সাড়ে দশ মিটার প্রস্থের সেতু নির্মাণ করা হয়। রাণীগঞ্জ ও রসুলপুর এলাকার মধ্যে এই সেতুর অবস্থান। সেতুতে রয়েছে ১৫টি স্প্যান ও ১৬টি পিলার। ফ্ল্যাড লেভেল থেকে ১২ মিটার উঁচু দুই লেনের সেতুর দুই পাশে রয়েছে আড়াই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, দুটি কালভার্ট, টোলপ্লাজা, এক্সেল লোড ও কন্ট্রোল স্টেশন।
সূত্র আরও জানায়, সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট। ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু ও আড়াই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং টোল প্লাজা নির্মাণকাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ২৪ ব্যুরো কোম্পানি লিমিটেড ২৪ বি এবং এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-এমবিইএল। চুক্তি অনুযায়ী ৭০২ দশমিক ৩২ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ দশমিক ২৫ মিটার প্রস্থ সেতুটির নির্মাণকাজ ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ছয় বছরে এসে শেষ হয় কাজ।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, সেতুর প্রকল্প নকশা সংশোধন ও করোনা পরিস্থিতির জন্য এই কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত সময় লেগেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ শুরু করেন।
২০০১ সালে বিএনপিসহ চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ওই সড়ক অপ্রয়োজনীয় উল্লেখ করে সড়কের বরাদ্দ বন্ধ করে দিলে সেতু নির্মাণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে সুনামগঞ্জ-৩ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর) আসনের সংসদ সদস্য বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ওই আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ পুনরায় চালুর প্রচেষ্টা চালান। একপর্যায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার তালিকায় এটি নিয়ে আসেন এবং একনেকে ৫২ কোটি টাকার অনুমোদন হয়।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের ২৫ জুন একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী এই সেতুর ১২৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেন। পরে ওই বছরের জুন মাসে সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে অংশ নেয় দেশি-বিদেশি তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবশেষে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে যৌথভাবে কার্যাদেশ পায় চায়না রেলওয়ে ২৪ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২৪বি এবং এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-এমবিইএল। পরে ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি বর্তমান সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
নির্মাণকাজের সময়সীমা তিন বছর ও ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে ব্যয় এবং সময় বাড়ানো হয়।
সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগের আওতায় নির্মিত ১৭টি সেতুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম সেতু হলো- (১) রাণীগঞ্জ সেতু, (২) আক্তাপাড়া সেতু, (৩) কোন্দানালা সেতু, (৪) দাড়াঁখাই, (৫) কলকলিয়া সেতু, (৬) কুশিলা সেতু, (৭) নাদামপুর সেতু, (৮) কাটাখাল সেতু, (৯) তকিপুর সেতু, (১০) ঘরগাঁও সেতু, (১১) হাসনাবাদ সেতু, (১২) মাধবপুর সেতু, (১৩) পেপারমিল সেতু, (১৪) রহমতবাগ সেতু, (১৫) টেংগারগাঁও সেতু, (১৬) লক্ষীবাউর সেতু ও (১৭) নৈনগাঁও সেতু।