মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক:
সিলেটের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যের ২০২২ সালের বন্যা। একটা বন্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আরেকটা বন্যার কবলে আধ্যাতিক শহর সিলেট। বানভাসি মানুষের কাছে এক মাস আগের বন্যার চেয়ে এবারের বন্যার রূপ আরও দুর্ভোগের ও ভয়ানক। ভারতের পানিতে ভাসছে আধ্যাতিক শহর সিলেট, এটাই সত্য। পানির কারণে আমার দেশের মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জীবন হারাবে? শুধু যে মানুষ কষ্টে আছে তা নয়, অসহায় গরু-ছাগলও পানিতে ভাসছে। মূহূর্তে বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে কষ্টে অর্জিত আপন ঘর-বাড়ি। প্রাণহানীও হচ্ছে। এই যে বাড়তি পানি, কই থেকে আসছে, তা কেন আমাদের মাথায় আসছে না? সিলেটে ক‘দিন থেকেই মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মানুষ পাশাপাশি গরু ছাগলের বাস ছিল।
আধ্যাতিক শহর সিলেট বন্যার পানিতে নদীর আশপাশ জায়গার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় থাকলেও অন্য এলাকাগুলো নিরাপদে ছিল। কিন্তু সেদিন ১৮ জুন ২০২২ সকাল থেকেই একটানা ভারি বর্ষণ প্রবাহিত হওয়ার ফলে শহরের কোন এলাকা বাদ যায়নি বন্যার কবল থেকে। ভারি বর্ষণের ফলে অনেকটা অপ্রস্তুত ভাবেই প্রতিটি ঘরে পানি ঢুকে যায়। শহরে পানিগুলো এতো দ্রুত ঘরে ঢুকে কারো বাসায় কোমর পানি কারো বা গলা পানি। মানুষ ভাবতেই পারেনি এমন করে হঠাৎ পানি বেড়ে প্রত্যেকের ঘরকে যে তছনছ করে দিবে। মানুষ তখন নিজেকে বাঁচাবে না, না নিজের ঘরের জিনিসপত্র বাঁচাবে। অনেকের ঘরে খাটের বিছানা-বালিশ পর্যন্ত তুলতে পারেন নি মুহূর্তে ঘরে কোমর পানি। ঘরের আসবাসপত্র ভিজে একাকার। কেউ কেউ জিনিস পত্রের মায়া ত্যাগ করে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছেন আবার কেউবা খাটের উপর খাট রেখে বাঁচার তাগিদে পানির মধ্যে ঘরেই বসে রয়েছেন। ভাবছেন পানি কমলে বের হবেন কিন্তু পানির স্রোত এতো বেশি যে খাটের উপর খাট রেখেও কোন লাভ হয়নি চাল অবধি পানি যখন হয়েছে তখন আর বের হওয়ার সুযোগই পাননি পানিবন্দি মানুষ গুলো।
শহরের বেশির ভাগ বস্তি এলাকার মানুষগুলো শুধুমাত্র জান নিয়ে বেঁচে গেছেন। গরীব অসহায় যারা তারা বাহিরে কাজে ছিলেন। হঠাৎ পানি আসাতে তাদের ঘরের সব জিনিস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে, ভেসে গেছে তাদের ঘরের সকল জিনিসপত্র। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ছিল কান্নার রোল সবাই সবকিছু হারিয়ে দিশেহারা। হাউমাউ করে বাচ্চার মতো কাঁদছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। এসব গরীব অসহায় মানুষগুলোর যেটুকুই বা ঘরে সম্বল ছিল তা চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখেছেন।
বন্যার পানিতে ভেসে যায় কারো প্রিয় মানুষটি। বানভাসি মানুষগুলো কিভাবে মেনে নিবেন এসব কষ্টের দৃশ্য। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারটি সারাবছর যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে গরু-ছাগলগুলোর যত্ন করে লালন পালন করে আসছিল আগামি কোরবানী ঈদে বিক্রি করবে দু‘টাকা লাভের আশায়। তার গরুও বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। তার স্বপ্নও মরে গেছে সাথে সাথে। সারাবছরের খাটুনিও পানির নিচে তলিয়ে গেছে মুহূর্তে। এসব পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। বন্যার পানি চলে গেলেও তারা হয়তো ঘরে ফিরবেন কিন্তু ঘরে গিয়ে তারা কোথায় মাথা রাখবেন? পরনের কাপড় ছাড়া তো আর কিছুই যে তাদের অবশিষ্ট নেই। কি হৃদয় বিদারক দৃশ্য যা লিখতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার কাজে বা খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নৌকা। কিন্তু সেই নৌকার অভাব দেখা দিল। সরকার, বিভিন্ন বড় ব্যবসায়ী, দলীয় নেতা কর্মী, বিভিন্ন সংগঠনের সমাজসেবক সবারই কম বেশি সহযোগিতায় কাঠের নৌকা, ইঞ্জিন নৌকা, স্পিড বোড সংগ্রহ করে যে যতটুকু পারছেন উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। এই বন্যায় যেহেতু শহরে বা গ্রামে অন্য কোন যানবাহন চলাচল করতে পারেনি তাই সবাই নৌকার উপর নির্ভশীল ছিলেন আর সেই সুযোগে নৌকার ভাড়ার পরিমাণ হয়ে যায় আকাশচুম্বি। যেখানে নৌকার ভাড়া হাজার, বারো‘শ সেখানে ভাড়া গিয়ে দাঁড়ায় চল্লিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার-ভাবা যায়? মাঝিরা এক লাফে লাখপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। একজন ডেলিভারি রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে ভাড়া চাইলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। কত বড় কসাই হলে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারেন একজন মাঝি। স্বামী নানা আকুতি মিনতি করেও কোন লাভ হয়নি। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিদ্যুৎ নেই পুরো শহরে প্রয়োজন আলোর তাই বন্যা কবলিত মানুষ গুলো ছুটছে আলোর সন্ধানে। পানির মধ্যে অন্ধকার ঘরে মোমবাতি দরকার। মোমবাতি কিনতে গিয়ে জনতা অবাক। ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকা থেকে ৮০টাকা। যে যেভাবে পারছে দাম বাড়িয়ে মোমবাতি বিক্রি করছে। বাসভাসী মানুষগুলো অসহায় বাধ্য হয়ে মোমবাতি কিনছে। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে লাভ খুঁজেন। ৫ টাকার মোমবাতি যখন ৮০ টাকায় বিক্রি করছেন তখন তাদের মানবিকতা কই থাকে? এরাই আবার দাঁড়ি রাখে, টুপি পড়ে, মসজিদে পাঁচবার নামায পড়ে। এই বন্যায় কেউ ফকির হচ্ছেন কেউবা লাখপতি। কথায় আছে মানুষ মানুষের জন্য কিন্তু এসব আজ মাঠে ময়দানে নেই। কঠিন বিপদে মানুষ যেখানে সাহায্যের হাত বাড়াবে সেখানে অনেকেই দেখা যাচ্ছে অসহায়দের প্রতি সবলদের কড়া আচরণ যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপন্থি। তবে এটাও সত্য মন্দ গুলো প্রচার হয় বেশি ভালোগুলো প্রচার হয় কম। অবশ্যই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আলেম সমাজ। তাদের মধ্যে নিবিড় মানব সেবা করে যাচ্ছেন যে সকল আলেমদের মাধ্যে অন্যতম ফুলতলী দরবারে পীর আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী।
বন্যার্তদের প্রত্যেকেই শুকনো খাবার দিচ্ছেন মুড়ি, চিড়া, গুড়, বিস্কুট, বিশুদ্ধ পানি আর এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা এগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোথাও একটুকু সহায়তা করবেন তা না তারা উল্টো এগুলোর দাম বাড়িয়ে মুনাফা গুলো পকেটে ভরে নিচ্ছেন। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সবকিছুতে লাভ খুঁজেন। সুযোগ বুজে দাম বাড়ান, এদের কোন মানবতা নেই এরা লাখ লাখ মানুষ মরে গেলেও দেখা যাবে তারা কাফনের কাপড়ের দাম বাড়িয়ে নিয়েছেন। দেশের যেকোন কঠিন বিপদে যুব সমাজ এগিয়ে থাকে সর্বদা। তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন অসহায়দের প্রতি। এই বন্যায় সহায়তা করছেন এদেশের যুব সমাজ। কিছু তরুণ মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায় দিন রাত পানির মধ্যে থেকেছেন। বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে বন্যার্তদের পাশে থেকেছেন। এদের দেখলে মনে হয় মানবতা হারায়নি। তাদেরকে কেউ না চিনলে তাদের মানবিকতায় এখন তারা অনেকের পরিচিত জন হয়েছেন যেমন তেমন ভালবাসার পাত্রও হয়েছেন। তরুণরা বেশি পরিমাণ আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্যায় দুর্গত মানুষের প্রতি। আমাদের প্রবাসিরাও যে যতটুকু পারছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন, রাব্বে কারিম তাদের দানকে কবুল করুন। আমিন।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক