অনলাইন ডেস্ক:
বাঙ্গালীদের মন-মানসিকতা সার্বিক পর্যালোচনার মাধ্যমে কোন একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। আবেগ তাড়িত এই জাতিকে শিক্ষার মাধ্যমে খুব বেশি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। “নিজে যারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়” – এটি খুবই প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ যা আত্মসংযমের উদ্দেশ্যে প্রণীত হলেও পরবর্তীতে সেই আত্মসংযম তীব্র গতিতে বেড়ে গিয়ে বাঙালি মন থেকে সম্পূর্ণ বিয়োজন হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলে হাজার বছরের ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে ইংরেজদের সুট বুট পড়া শুরু করা থেকেই এই জাতি নিজেকে মিথ্যেভাবে জাহির করা শুরু করে। কিন্তু সেই মিথ্যে ভাবে জাহির করার বিষয়টি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে এলো তখন তা অতীতের সব সীমাকেই লংঘন করেছে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে মিথ্যেভাবে উপস্থাপন করছে। এর ক্ষেত্র এবং উদ্দেশ্য রীতিমত একটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ে তা হল অধিকাংশ ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জা বা মেকাপের আড়ালে ঢেকে নিজেকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করছেন। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত নিজের ছবিতে এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভাবে ঐ ব্যক্তি উপস্থাপিত হচ্ছে তার সাথে প্রকৃত ব্যক্তির অধিকাংশই ক্ষেত্রেই মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। যার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে সৃষ্ট সকল সম্পর্ক খুব বেশিদিন স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। কারণ এ ধরনের মিথ্যে আবরণে ঢাকা ব্যক্তি সমূহকে বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়ার পর সেই ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সার্বিক অবয়বের সাথে তার বাস্তব জীবনের প্রকৃত রূপের মিল না পাওয়ার কারণে তার সম্পর্কে পূর্বে যে সম্মানবোধ বা আকর্ষণ কাজ করতো তা খুব অল্প সময়ে বাষ্প হয়ে উড়ে যায় এবং সম্পর্কগুলোতে আকস্মিক পরিবর্তন আসে।
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এর ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আদিকাল থেকেই একটি বিভ্রান্তি রয়েছে যা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই জাতি ভুলতে পারেনি এবং তার রক্ত থেকে দূরীভূত করতে পারেনি। এই লেখার বিষয়বস্তুর প্রয়োজনেই একজন আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক নাওমি ওল্ফের লেখা একটি বইয়ের কিছু তথ্য তুলে ধরছি। “মিথ অফ বিউটি” নারীবাদী তত্ত্বের উপর লেখা একটি ক্লাসিক রচনা, মূলত ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে এটি লেখা হয়েছিল । এতে, লেখক বহু অধ্যয়ন এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে, নারী মুক্তি, নারীর অগ্রগতি এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তির উপর আলোকপাত করেছেন।এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা উচিত যে “মিথ অফ বিউটি” এর উল্লেখের মাধ্যমে আমি কোনভাবেই সরাসরি নারীদেরকে আমার লেখার একমাত্র বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতীয়মান করতে রাজি নই বরং লেখার প্রয়োজনেই এর আবির্ভাব হয়েছে।
অধিকাংশ সময় আমরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ফিকে বা স্বল্পমেয়াদী মনোভাব পোষণ করে থাকি কারণ এই মনোভাবের দীর্ঘমেয়াদে যখন তা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করে তখন তা থেকে আমরা নিরবে সরে আসি। এখন প্রশ্ন হলো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমরা যে এত কথা বলি তা কি প্রকৃত অর্থে আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি? অনেকেই বলে থাকেন যে মানুষ সমাজে শ্বেতাঙ্গদের অনেক বেশি দাম দিয়ে থাকেন যেসব ব্যক্তির গায়ের রং ভালো তাদেরকে অনেক বেশি দাম দিয়ে থাকেন এবং যাদের গায়ের রং শ্যামলা বা কালো তারা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজে তাদের উপযুক্ত জায়গা গড়ে তুলতে পারেননা এবং সবক্ষেত্রে সমান প্রাধান্য পাননা; যেটাকে তারা এক ধরনের অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করেন। আমিও তাদের সাথে একমত কিন্তু একটি জায়গায় আমি কোনোভাবেই একমত হতে পারিনা যে তারা যখন নিজেদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের প্রকৃত রূপকে ভিন্নভাবে প্রদর্শনের চেষ্টায় রত থাকেন। এতে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তারা কি নিজেরা এই বর্ণবাদের অপবাদে নিজেদেরকেই আঘাত করছে না। কারন তারা নিজেরাই তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত শারীরিক অবস্থাকে বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তন করে সেইসব সাদা চামড়ার মানুষ বা সমাজের চোখে তথাকথিত সুন্দর মানুষ গুলোর মত করতে চাচ্ছে। এতে কি তারা তাদের নিজেদেরকে অপমান করছে না? এটাও যদি একটা অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয় তাহলে সমাজকে আলাদা করে দোষ দেবার মত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। যতদিন না পর্যন্ত তারা তাদের এই ধরনের আচরণ পরিবর্তন করবে না ততদিন পর্যন্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা মানুষ যদি নিজে নিজের শারীরিক অবয়বকে স্বাভাবিক এবং সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে এবং উপস্থাপন করতে লজ্জাবোধ না করে তবেই সেই অবয়ব বা শারীরিক রূপ একসময় গিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হিসেবে সমাজে বিবেচিত হবে।
আমি মনে করি আমাদের সবসময় নিজেদেরকে একটু কম প্রদর্শন করা উচিত। আমরা ঠিক যতটা; প্রদর্শন করা উচিৎ ঠিক তার অর্ধেক। কারণ আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, রূপ এবং আমাদের ব্যক্তিগত অবস্থান সব সময় জাহির করতে চাই, তাহলে তা সাময়িক ভাবে লোকমনে দাগ কাটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বিরক্তির কারণ হতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে জাহির করা একশটি তথ্য থেকে যদি একটিও ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে ঠিক সেইসব ব্যক্তি যারা আমাদের জাহির করা তথ্য শুনে বা দেখে ঠিক যতটা আমাদেরকে দেবতাতুল্য মনে করে মাথায় তুলে রেখেছিল; ঠিক সেই অবস্থান থেকেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেলতে একমুহূর্ত দ্বিধাবোধ করবে না। তারচেয়ে বরং আমাদের উচিত নিজেদেরকে কম প্রকাশ করা এবং আশেপাশের মানুষগুলোকে নিজ থেকেই আমাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ প্রদান করা। তাহলে তারা নিজ থেকে যা জানবে তা সবসময় তারা সত্য হিসেবেই মানবে এবং তার উপর নির্ভর করে আমাদেরকে যে সম্মান করবে তার সব সময় টিকে থাকবে। কামিনী রায়ের ‘অনুকারীর প্রতি’ নামের কবিতায় এই ভিন্ন জীবনদর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি অকাতর চিত্তে তার কবিতায় বলেছেন ; “পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যা রে / খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি না রে।”
লেখক: সবুজ ভট্টাচার্য্য