করোনা মহামারি আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নেতিবাচক ধারায় দেশের অর্থনীতি। ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়েই চলেছে।
বাজেটে আয়-ব্যয় : নতুন অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কর বাবদ চার লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া ৫০ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। কর বাবদ যে রাজস্ব আসবে তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ২০ হাজার কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় বাবদ চার লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। পাশাপাশি মূলধন ব্যয় ৩৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ঋণ ও অগ্রিম বাবদ ব্যয় হবে আট হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া খাদ্যে ব্যয় হিসেবে ৫০২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
এডিপি : বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বড় ঘাটতি : বাজেটে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার (অনুদান ছাড়া) ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেবে আরো পাঁচ হাজার কোটি টাকা। নিট বৈদেশিক ঋণ নেবে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
ধনীদের সারচার্জের ক্ষেত্রে আরো ছাড় : ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জের ক্ষেত্রে আবার ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এত দিন তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলেই সারচার্জ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এই সীমা বাড়িয়ে চার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাব অনুযায়ী, নিট সম্পদের পরিমাণ চার কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে হলে ওই ব্যক্তির করের ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে কিংবা নিজ নামে একাধিক গাড়ি বা আট হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের গৃহসম্পত্তি থাকলেও ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে।
করজালের বিস্তার : প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজস্ব আহরণে ভ্যাটনির্ভরতা বাড়ানো হবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বাড়বে। রাজস্ব আহরণের প্রধান খাত হিসেবে ভ্যাট আদায়কে বিবেচনায় নিয়ে এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর না দিয়ে পরোক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়ায় ভ্যাটের চাপে নাকাল হবে সাধারণ ভোক্তা। পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.২৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকারের কিভাবে আগামী অর্থবছর গড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হবে তা আমার বোধগম্য নয়। বিশেষ করে সরকারের ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নসহ অন্য যেসব কর্মপরিকল্পনা দেখছি, সেখানে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল নেই। সরকার বলছে এটি গরিববান্ধব বাজেট, কিন্তু তারা পদক্ষেপ নিয়েছে উল্টো। এই বাজেট পাস হলে বরং গরিবসহ মধ্যবিত্তরা চাপে পড়বে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত পূরণে কঠিন চাপে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আইএমএফের অনুমোদিত ঋণের বড় শর্ত হচ্ছে, রাজস্ব খাতে সংস্কার আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছর থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৫ শতাংশ বাড়িয়ে কর আদায় করতে হবে।
বাজেটে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা থেকে আরো ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণে এনবিআরের তিনটি খাতের মধ্যে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ভ্যাট আদায়ে।
দুই হাজার টাকা দিতেই হবে : রিটার্নের প্রমাণপত্র পেতে করদাতাকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে—এমন প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ৪৪ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে। তাদের এখন এসব সেবা পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যে বলেন, ‘করমুক্ত সীমার নিচে আয় রয়েছে, অথচ সরকার থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের বাধ্যবাধকতা আছে, এমন করদাতার ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত বাজেটে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে মূল লক্ষ্যগুলো পূরণ করার ক্ষেত্রে, সেই ঘাটতিগুলো বিবেচনা না করে আবার নতুন করে যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো দেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য যা বলা হচ্ছে, তা আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। যে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা আছে সেটাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ দরকার সেই পরিমাণ অর্থ সরকারের কাছে নেই। সরকার এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো চালাতে পারছে না, আমদানিতে ডলারের জোগান দিতে না পারায়। এই বাজেট অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। কারণ আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি।’
কৃষিতে ভর্তুকি কমছে : বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমানো হয়েছে ৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩৪.৩২ শতাংশ)। আর জনপ্রশাসনে মোট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৫২ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে ১৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম : আগামী জুলাই থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশনের কাজ শুরু করবে সরকার। প্রবাসী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতাভুক্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক প্রডাক্ট নিয়ে জুলাই মাসের শুরু থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে পাইলট আকারে সর্বজনীন পেনশনে দেশের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু হবে। তবে যে কর্তৃপক্ষের অধীনে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হবে, তা এখনো গঠন করা হয়নি। এমনকি প্রডাক্টগুলো এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
সামাজিক সুরক্ষা : সরকার দেশের গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি কিছুটা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যাও কিছুটা বাড়বে আগামী বছরে।
অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম খাতে মোট এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬.৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫২ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। ঋণনির্ভর বড় ঘাটতির এই বাজেটে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে। বাজেটে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে।’
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন