Friday , 22 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
সাইবার আইনের ৪টি ধারা অজামিনযোগ্য থাকছে
--সংগৃহীত ছবি

সাইবার আইনের ৪টি ধারা অজামিনযোগ্য থাকছে

অনলাইন ডেস্ক:

চারটি ধারা অজামিনযোগ্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে দুটি ধারা জামিনযোগ্য করা ছাড়া এর খসড়ায় উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন আসেনি। গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়।

সাইবারতথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন  বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অজামিনযোগ্য ধারা ছিল ছয়টি। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২১ ও ৩০ নম্বর ধারা দুটিও জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এখন অজামিনযোগ্য ধারা আছে চারটি। এই চারটি ধারা কারিগরি হওয়ায় জামিনযোগ্য করা সম্ভব হয়নি।

সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন করছে। গত ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, যেকোনো আইনের সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গা বিচারের আগে আটক থাকা।

গত ৯ আগস্ট আইনটির খসড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়। এ জন্য সময় ছিল ১৪ দিন । প্রায় ৫০০টি মতামত জমা পড়ে। এসব মতামতের মধ্যে বেশির ভাগ প্রস্তাব ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে। তবে এসব মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোনো প্রতিকার নেই এই আইনে।

গতকাল বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘নীতিগত অনুমোদনের সময় যে খসড়াটি ছিল সেখানে দু-একটি সংজ্ঞাসহ সামান্য কিছু পরিমার্জন করে আজকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইনটির ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩ এ চারটি ধারা ‘অজামিনযোগ্য’ রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বে-আইনি প্রবেশ (ধারা-১৭), কম্পিউটার ও কম্পিউটার সিস্টেমে ইত্যাদির ক্ষতিসাধন (ধারা-১৯), সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংগঠনের অপরাধ (ধারা-২৭) এবং হ্যাকিং-সংক্রান্ত অপরাধ (ধারা-৩৩) এ ধারাগুলো অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে।’

অংশীজনদের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আপনি ওই মন্ত্রণালয়কে (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ) জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে। আমাদের কাছে খসড়াটা চলে আসে, প্রসেসটা আমাদের কাছে আসে না।’

সংজ্ঞার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে বা ভেতর থেকে কেউ যখন কোনো কিছু করে, কোন কাজটা করলে অপরাধ হবে, সেখানে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ শব্দটা বসানো হয়েছে। একটা ধারায় ছিল ‘জাতির পিতা’ সেটা বাদ দিয়ে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ করা হয়েছে। এটা মেজর কিছু না, স্পষ্টকরণ হয়েছে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো সুপারিশে আইনের যে দুটি ধারা বাতিল এবং আটটি ধারা সংশোধনের কথা বলেছে, সেগুলোর বিষয়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা আগেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাতিলের জন্য বলা ধারা হচ্ছে ২১ ও ২৮। যেগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা।

এ ছাড়া সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বিবৃতিও দিয়েছিল, তাতে আইনটির ৯টি ধারার (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মৌলিক কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল। এরপর গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার, নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা যাঁরাই পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরাই এ নিয়ে বারবার বলেছেন, সামগ্রিকভাবে এ আইন ও বিশেষভাবে কতিপয় ধারা অগ্রহণযোগ্য এবং তা আন্তর্জাতিক যেসব সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ ধারা আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ছিল। গতকাল ২১ ও ৩০ ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এখন ১৭, ১৯, ২৭ ও ৩৩ ধারা অজামিনযোগ্য থাকছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি। আগে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারা আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য ছিল। এখন চারটি ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের সুযোগ বহাল থাকছে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে পাস হতে পারে। আইনমন্ত্রী গত ৭ আগস্ট বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরে এ আইন পাস হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়ম অনুসারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত বিলটি সংসদ সচিবালয়ে পাঠানো হবে। এরপর বিলটি সংসদে উত্থাপনের জন্য সংসদের কার্যতালিকাভুক্ত করা হবে। সংসদে উত্থাপনের পর অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আকারে বিলটি সংসদে পাস হবে। আগামী ৩ সেপ্টেম্বর সংসদের অধিবেশন শুরু হবে। ওই দিন সংসদের কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে অধিবেশনের মেয়াদ ও কার্যসূচি চূড়ান্ত করা হবে।

চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে উদ্বেগ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ২২ আগস্ট ‘বাংলাদেশ: সরকারকে খোলা চিঠি, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক ২৫ পৃষ্ঠার পর্যালোচনা সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে আইনটির খসড়া পর্যালোচনা করে সংস্থাটির মনে হয়েছে, এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দমনমূলক বিধিগুলো রয়ে গেছে। সংস্থাটির পর্যালোচনা ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫ (মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য প্রকাশ), ধারা ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ) এবং ধারা ৩১ (আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর শাস্তি) সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অবিকৃত রয়েছে।

খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন’ করার মতো বিষয়ের কোনো ব্যাখ্যা না থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ২৯ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রয়েছে। শুধু এ ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের বদলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় এই ধারার অপপ্রয়োগের ঝুঁকি থাকছে।’

ব্লাস্টের পর্যালোচনা

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে বিষয়টি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করে। এতে উদ্বেগ জানিয়ে এই মর্মে বলা হয় যে প্রস্তাবিত নতুন আইনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা অপরাধের সংজ্ঞা বা প্রযোজ্য পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনে না। খসড়া আইনের বেশ কিছু বিধানে (ধারা ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩, এবং ৫৩) বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ বজায় রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিবৃত উদ্দেশ্যগুলো হলো সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধগুলো শনাক্ত, প্রতিরোধ এবং বিচার করা। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে নারী, শিশু এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাইবার অপরাধগুলোকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা নেই।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply