তিন মাসে নিয়েছে ৫৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ইতিবাচক বলছেন বিশেষজ্ঞরা
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (তিন মাস) শেষ হয়েছে মাত্র; তবে এরই মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকের বেশি ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে সরকারের এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি ঋণ গ্রহণ স্মরণকালের মধ্যে আর ঘটেনি। তবে করোনাকালে সরকারের এ ব্যাংক ঋণ গ্রহণের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গেছে সরকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা; ছয় মাসের মধ্যে সে লক্ষ্য ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার ব্যাংক থেকে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এটি ছিল গত ১০ বছরের মধ্যে ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণের রেকর্ড। আর চলতি অর্থবছরের তিন মাসে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ সেটিও ছাড়িয়ে গেছে। যে হারে প্রতি মাসে ব্যাংক ঋণ নেওয়া হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি টাকা নিয়ে নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে সরকারের এ ঋণ বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে বরং ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষণা পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কভিড-১৯-এর কারণে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অর্থনীতি যাচ্ছে তাতে সরকারের এ ব্যাংক ঋণ গ্রহণের বিষয়টি বরং ইতিবাচক মনে হচ্ছে। কারণ ১. ব্যাংক ঋণ নিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হবে, যা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। ২. কভিড-১৯-এর কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম, ব্যাংকগুলোয় তারল্য উপচে পড়ছে। এ অবস্থায় সরকার এ তারল্য সঠিকভাবে ব্যবহার করলে অলস টাকার পরিমাণ কমবে। ৩. সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়লে সুদ বাবদ সরকারের দায় বৃদ্ধি পায়। সে হিসেবে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আর্থিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’
জায়েদ বখত বলেন, ‘কভিড-১৯-এর ফার্স্ট ওয়েভ আমরা হজম করে ফেলেছি। এখন সেকেন্ড ওয়েভটা কোনোভাবে মোকাবিলা করতে পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। সে কারণে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যদি সরকারি বিনিয়োগে গতি বাড়ানো যায়, সেটি বেসরকারি বিনিয়োগকেও উজ্জীবিত করবে।’
প্রথম প্রান্তিকেই কেন এত ঋণ : সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যয় মেটাতে গিয়ে হঠাৎ ঋণ গ্রহণ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) যে পরিমাণ ব্যাংক ঋণ নিয়েছিল সরকার, এবার প্রথম তিন মাসে তার চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ তিন মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণ ছিল ৪৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তা বেড়ে ৫৭ হাজার ৭০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে ২৪ হাজার ৫০০ কোটি, আগস্টে ১৮ হাজার কোটি ও সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার।
ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘কোনো বছর বাজেটে রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিলে পরের অর্থবছরের প্রথম দিকে সরকারের ঋণ বেড়ে যায়। কভিড-১৯-এর কারণে গত অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম ছিল। তা মোকাবিলা করতে গিয়েই এখন ঋণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কর জিডিপি অনুপাত অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম, এটি বাড়াতে হবে। না হয়, আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।’