সুস্বাস্থ্য সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য ছাড়া জীবনের সকল অর্জনেই বৃথা। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য যেমন প্রয়োজন, সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য। প্রতিদিন আমরা খাবার গ্রহণের সময় নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছি। যা খাচ্ছি তা বিষ নয় তো? ফলমূলে কেমিকেল, মাছে ফরমালিন, মাংসে ক্ষতিকর হরমোন, শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ- এ ধরনের অনেক সংশয় ও আতঙ্কের মধ্যেই আছি। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরি হলেও তার চেয়ে বেশি জরুরি নিরাপদ খাদ্য। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিরই কারণ নয়, বরং দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার দ্বার পর্যন্ত খাদ্যের গুণগণ মান নিশ্চিত রাখা সরকারি ও বেসরকারি সকলের দায়িত্ব। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বর্তমানে বেশ আলোচিত। নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল ও কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষ এ খাবার গ্রহণ করছে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। মানুষের সুস্থ জীবনের জন্য যে খাদ্য দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ করে সে সকল স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনীতি, নিরাপদ খাবার ও উপযুক্ত পরিবেশ যে কোনো উন্নয়নের উপাত্ত বৃদ্ধি করে, এগুলো এড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন অর্জন আদৌ সম্ভব নয়। নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। আধুনিক জীবনে শিল্পজাত খাদ্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ খাদ্যকে স্বাভাবিক এবং ভেজাল ও অন্যান্য দূষণ থেকে নিরাপদ অবস্থায় বিতরণ এখন একটি বিশ্ব সমস্যা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের প্রায় সকল খাদ্যেই ভেজাল রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাওয়া দুষ্কর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, আমরা অনেকেই পরিমিত ও সুষম খাবারের দিকে খেয়াল করে খাবার গ্রহণ করি না। যারাও বা বোঝেন, তাদের একটি বিরাট অংশের ধারণা হল পুঁথিগত, যার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। খাদ্যের গুণগত পুষ্টিমান ও খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত রয়েগেছে। নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে না পারলে একসময় আমরা রুগ্ন জাতিতে পরিণত হব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতি বছর মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, এরমধ্যে প্রতি বছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। আমাদের দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পষ্টিহীনতায় ভুগছে পরিমিত সুষম খাবার না খাওয়ার জন্য। এছাড়া খাদ্যে ভেজালের দৌরাত্মের কারণে দেশে প্রতি বছর তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রয় দুই লাখ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১ লাখ ৫০ হাজার। গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৭০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ খাদ্যে ও ঔষধে ভেজাল। এক গবেষণা সূত্রে জানা যায়, আমাদের শরীরে ৩৩ শতাংশ রোগ হওয়ার পেছনে রয়েছে ভেজাল খাদ্য। এই ভেজাল খাদ্য ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে সরকারকে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নাহলে, এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। খাদ্যে ভেজাল শুধু যে শারীরিক ক্ষতি তা নয়, এর কারণে জাতীয় উন্নতিও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
আমাদের দেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয় এবং নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তায় ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণীত হয়। ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তবে এসব আইন ও কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেজালবিরোধী অভিযান চালালেও খাদ্য ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও ১৪ বছরের কারাদ- বিধান রাখা হয়েছে। আমরা আশা করব, ভেজালবিরোধী অভিযান কঠোর হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ পাশাপাশি ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে অভিযান নিয়মিত থাকলে ভেজালকারীদেও দৌরাত্ম অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়। তবে ভেজাল ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। শুধু সরকারের একার পক্ষে এবং আইন দিয়ে ভেজাল ঠেকানো সম্ভব নয়। এ জন্য সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের উচিৎ, সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং বিপন পর্যন্ত নিরাপদ খাবার নিশ্চিতকরণের বিধি-বিধানগুলো পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করা দরকার। নাহলে, নিরাপদ খাদ্যও অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম জনশক্তি অপরিহার্য। আর কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নিরাপদ খাদ্য যেমন সবার জন্য প্রয়োজন। তেমনি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকলকে সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনকি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে আশা করতে পারি।
মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
লেখক: প্রাবন্ধিক