একবার উইন্সটন চার্চিলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রাজনীতিক বা রাজনীতিবিদ কে বা কাকে বলা যায়। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘The ability to foretell what is going to happen tomorrow, next week, next month and next year. And to have the ability afterwords to explain why it did not happen.’ (Ref: Dominique Enright, The wicked wit of Churchill, Page-17).
কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। এ কথা ওই দিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে প্রচার এবং তার পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হয়। ঠিক তার পরের দিনই আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা উপরোক্ত সংলাপের কথা প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তাতে চার্চিলের সংজ্ঞা মতে তাঁরা প্রকৃত রাজনীতিকের পারঙ্গমতা কতটুকু দেখাতে পেরেছেন, তা নিয়ে মানুষ এখন অনেক কথাই বলছে।
এভাবেই বিএনপির কার্যকলাপের ফলে তাদের হাত ধরেই জবাবদিহিহীন, অগণতান্ত্রিক ও জনসম্পর্কহীন একটি উদ্ভট ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে, যার বিষাক্ত ছোবলে ২০০৭-০৮ মেয়াদে বাংলাদেশ সব কিছু হারাতে বসে। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সপ্তম সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা, মেয়াদান্তে ২০০১ সালের মধ্য জুলাইয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সংবিধান অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব হস্তান্তর করে দেয়। কিন্তু জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ছবি পর্যন্ত বিএনপির ক্যাডার বাহিনী কর্তৃক চরম অবমাননার পরও সালসা সংঘের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীরব থাকায় মানুষের কাছে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় এবং নির্বাচনটি যেভাবে সম্পন্ন হয়, তাতে সামগ্রিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি জনমানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেল।
২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য অন্য ক্যাডার সার্ভিস নয়, শুধু উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয়, যাতে বিএনপির একান্ত পছন্দের প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। একই সময়ে বিএনপির নিয়োগকৃত এম এ আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করে। সংগত কারণেই ২০০৬ সালের শেষের দিকে আবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। আপস-সমঝোতার জন্য দুই পক্ষের সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে একাধিকবার সংলাপ হয়। আবদুল মান্নান ভুঁইয়া ও আব্দুল জলিলের মুখচ্ছবি এখনো মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু সব কিছু নিষ্ফল হয়ে যায়।
২০০৭-০৮ মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষাক্ত দংশন থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কেউ রক্ষা পায় না। কিন্তু একসময়ে তারা জনমানুষের কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন হয়। বিএনপিসহ বিরোধী দলের দাবির মুখে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সমঝোতা করার জন্য অনেকটাই এগিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিএনপি নেত্রীকে টেলিফোন করেন। সমঝোতার প্রস্তাব দেন এবং আলোচনার আহ্বান জানান। কিন্তু খালেদা জিয়া আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বিএনপি নেত্রীর অনমনীয় অবস্থান এবং অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য এবারও সমঝোতা ও আপসের পথ নষ্ট হয়ে যায়।
সব রাজনৈতিক দলেরই দোষগুণ আছে। কিন্তু ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারে থেকে বিএনপির কর্মকাণ্ডের জন্য সে সময়গুলোতে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। তার পরও ২০১৪ সালেই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব আর খালেদা জিয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রত্যাখ্যান ইত্যাদির দ্বারা কী প্রমাণ হয়। এসব লিগ্যাসি মানুষের মনে জ্বলজ্বলে থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এমন কোনো দায়ে পড়েছে কি না, জানি না যে এখন বিএনপির রাজনৈতিক দাবি আওয়ামী লীগকে পূরণ করতে হবে, মেনে নিতে হবে। বিএনপির কর্মদোষের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। আবার তাদের ২০০৬ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিলুপ্তির পথ প্রসারিত হয়। আর ২০০৭-০৮ মেয়াদে বিষাক্ত থাবা দেখার পরও যারা এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছে, তারা দেশের কল্যাণে তো নয়ই, নিজেদের কল্যাণেও নয়, বরং নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো সর্বনাশা এক খেলায় নেমেছে। তাদের ভাবখানা এমন, দেশ গোল্লায় যাক, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিশ্চয়ই বিশ্লেষণ করবে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত ২৮ বছরে কখনোই কেন সংলাপ সফল হতে পারল না। সবাই ভালো চায়, তাহলে মন্দ চায় কে। মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর বাহাত্তরের সংবিধান, দুটি মহৎ অর্জনই হয়েছে দেশের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের ঐকমত্যে। একবার ভেবে দেখুন, এত বড় জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে অর্জিত ফসল যদি ভেঙে ফেলা হয়, তাহলে বর্তমান বাস্তবতায় আর কি কখনো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু করা যাবে? মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধান কোনো দলের নয়, জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই জায়গায় সব পক্ষ এক হয়ে সমবেত হলে, তারপর অন্যান্য যত বিষয় আছে, তা নিয়ে সংলাপ ও সমঝোতা সহজ হয়ে যাবে।
১৯৭৫ এবং তারপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে একটি পক্ষ শতকরা ওই ৮০ ভাগ মানুষের ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায় রত? সুতরাং সমঝোতা হবে কার সঙ্গে কার। যারা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে বিনাশ করতে চায়, তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আপস-সমঝোতা হয় কী করে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি তো বাংলাদেশে চলতে পারে না। যারা একাত্তরের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র মানে না এবং জাতির পিতার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না, তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যায়? সুতরাং আপস-সমঝোতা হতে হলে বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং জাতির পিতার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখাতে হবে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পথে অর্জিত ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলো আড়াল করা চলবে না, বরং সেগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। সমঝোতা ও আপসের শিকড় এখানেই নিহিত।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com