কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ। সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল স্বরচিত প্রতীক ‘ধূমকেতু’র মতোই। প্রস্থানও অনেকটা সেভাবেই। চির লড়াকু সৈনিক নজরুলের জীবন যেন এক নাটকীয় বিন্যাসে সাজানো।
প্রত্যন্ত জনপদের দারিদ্র্যজর্জর শৈশব থেকে সাহিত্যকৃতির মধ্যগগনে তাঁর উত্থান গল্পের মতোই। সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। কবিতায় এক নতুন ধারার প্রবর্তক নজরুল। বাংলা গানে যোগ করেছেন বাণী ও সুরের বৈচিত্র্য। সৃষ্টি করেছেন বাংলা গজল। কথাসাহিত্যেও সংযোজন করেছেন নতুন স্বর। আবার সাহিত্যজগতের বাইরে রাজনীতির মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামেও ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। প্রায় আক্ষরিক অর্থেই যেন তাঁর এক হাতে ছিল প্রেমের বাঁশরী, ‘আর হাতে’ বিদ্রোহের তূর্য।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের আজকের দিনটিতে (১২ ভাদ্র) ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট ১৯৭৬। সে হিসাবে আজ শনিবার তাঁর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রখর গ্রীষ্মে পড়া জন্ম দিবসের মতোই এদিনেও গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মানুষ স্মরণ করবে তাদের প্রিয় কবিকে।
নজরুল যখন লিখতে শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বজনীন স্বীকৃতি ও পরিচিতির মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে। রবীন্দ্রনাথের পর্বতপ্রতিম প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে নজরুল নিজস্ব ধারার মৌলিক সৃষ্টি নিয়ে হাজির হন। তাঁর সাহিত্য রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত তো ছিলই—এমনকি তিনি নিজেও একসময় হয়ে উঠলেন নতুন পথিকৃৎ। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার কমতি ছিল না। বাঙালির চিন্তা ও মননজুড়ে রয়েছেন এই দুই মহান কবি। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে এ কথাই উচ্চারিত হয়েছে তাই—‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ/চেতনাতে নজরুল/যতই আসুক বিঘ্ন-বিপদ/হাওয়া হোক প্রতিকূল। ’
‘যত সব বন্দী-শালায়/আগুন জ্বালা/আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি’ বলা ‘ভাঙার গানে’র নজরুলের জীবন সহজ ছিল না। লেখার জন্য জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে; কিন্তু যিনি মনেপ্রাণে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকারের পক্ষে তাঁকে রুখবার সাধ্য কার! ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কবি সৃষ্টি করেন তাঁর অমর দুই সৃষ্টিকর্ম ‘ভাঙার গান’ ও ‘বিদ্রোহী’। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রসঙ্গ ও প্রকরণগত বৈচিত্র্য, অভিনবত্ব ও স্বাতন্ত্র্য তাঁর সাহিত্যকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। ভাব-ভাষা-ছন্দে অভিনব বিদ্রোহী কবিতা অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা পায়। শত বছর পর আজও সাধারণ পাঠক ও গবেষকদের কাছে যে সমাদর পায় কবিতাটি, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল দৃষ্টান্ত। অনেক সমালোচক বলেছেন, এটি শুধু আধুনিক বাংলা সাহিত্য নয়, বিংশ শতাব্দীর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোরও অন্যতম।
সাংবাদিকতা ও পত্রপত্রিকা সম্পাদনা নজরুলের কর্মজীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯২০ থেকে ১৯৪২-এ অসুস্থ হওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত নজরুল সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’, দৈনিক ‘মোহাম্মদী’, দৈনিক ‘সেবক’, অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’, সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’, সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’, সাপ্তাহিক মাসিক ‘সওগাত’ ও দৈনিক ‘নবযুগ’ (নবপর্যায়) পত্রিকার সঙ্গে কখনো সাংবাদিকতা কখনো স্বত্বাধিকারী আবার কখনো বা সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
১৯৪২ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের আগস্টে জীবনের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবি অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ থেকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি দেয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করা হয়। তাঁর লেখা ‘চল চল চল’ গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত।
আজ শনিবার জাতীয় কবির ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে শোভাযাত্রাসহকারে কবির সমাধিতে গমন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ-ফাতিহা পাঠের কর্মসূচি পালন করবে। ৬টা ৪৫ মিনিটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। নজরুল ইনস্টিটিউট বিকেল সাড়ে ৫টায় ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবরে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সন্ধ্যা ৭টায় ছায়ানট মিলনায়তনে বিদ্যায়তনটির পক্ষ থেকে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন