অনলাইন ডেস্ক:
অর্থনীতি সমিতির ১১তম ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত: কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর তাগিদ
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করে শোভন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্রুত ঢেলে সাজানোর জন্য তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত “জনস্বাস্থ্য; কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জনস্বাস্থ্য: শোভন সমাজের সন্ধানে”শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় তাঁরা এই তাগিদ দেন।
গতকাল সন্ধ্যায় গণমানুষের অর্থনীতিবিদ-সমাজ গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গবেষণাগ্রন্থের ওপর ১৩ সিরিজের ওয়েবিনারের (ভার্চ্যুয়াল সেমিনার) ১১তম পর্বে প্যানেলিস্ট হিসেবে ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, কানাডার স্বাস্থ্য পরিবেশ ব্যুরোর প্রাক্তন সিনিয়র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এ. হান্নান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সরকার এখনো আড়াই শ বছর আগের কলোনিয়াল যুগেই আছে। আর সে কারণেই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ অর্থনীতির সবটুকুই খেয়ে ফেলছে। সরকার লক্ষ-কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে, যার বেশির ভাগই ধনীরা হাতিয়ে নিচ্ছে। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই স্বাস্থ্য খাতের সংকট দূর হবে না। টিকার প্রাপ্তি ও গবেষণা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার যা করেছে, তার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই জড়িত। তারাই তৃতীয় বিশ্বের গবেষণা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত করছে।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন বাংলাদেশে করোনার বিস্তার ও অর্থনীতির নাজুক অবস্থা হঠাৎ সৃষ্ট কোনো ঘটনা নয়। জোড়াতালির অর্থ বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সবই ধনীরা খেয়ে ফেলবে। এর জন্য আমাদের আগে গ্রামের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেখানে বৃহৎ জনগোষ্ঠী থাকে। তারা যেটুকু ভিটামিন ‘ডি পাচ্ছে, তা দিয়েই করোনাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। সেখানে চিকিৎসক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আবুল বারকাত এ যুগের কার্ল মার্কস। কাল মার্কসের ভাবনা বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটের উপযোগী করে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তার তত্ত্বকাঠামো উপস্থাপন করেছেন, যার প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বকে আসলেই সুন্দর করে গড়ে তোলা সম্ভব। ড. বারকাত তাঁর বইয়ে স্বাস্থ্যসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থার খুঁটিনাটি বিষয়ের কার্যকারণ এবং তা থেকে উত্তরণের যে পথনির্দেশনা দিয়েছেন, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার দাবি রাখে।
তিনি বলেন, আবুল বারকাতের নির্দেশিত শোভন পথে গেলে বাংলাদেশ আগামী ২০ বছরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শোভন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। সেখানে চিকিৎসক গমগম করবে, নার্স গমগম করবে। রোগীরা সেবা পাবে। মানুষের মনে বাঁচার আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হবে। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই স্বাস্থ্য খাত উন্নত হবে না। বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার হতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যন্ত্রপাতি কিনতে উৎসাহী, দেশীয় গবেষণায় বা ন্যায্য সেবা দিতে আগ্রহী না। রাষ্ট্রের সবকিছুতেই এখন সুশাসনের সংকট চলছে। সবাই মিলেই আমরা এটা অতিক্রম করব। কিন্তু এর জন্য আমাদের নতুন ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এ. হান্নান বলেন, অধ্যাপক আবুল বারকাত কিংবা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষেরা শুধু অর্থনীতিবিদ বা চিকিৎসক নন, তাঁরা সত্যিকারভাবে মানুষের দুর্ভাগ্যের অবসান চান। আর্থিকীকরণকৃত সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটনে এ ধরনের আরও মানুষ আমাদের প্রয়োজন।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, প্রকৃতিকে বন্ধু না ভেবে অতিরিক্ত উত্ত্যক্ত করায় মানুষ আজকে করোনাভাইরাসের এই সংকটে পড়েছে। সভ্যতার এই সংকট থেকে উত্তরণে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীসহ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য দূর করতে হবে। কোভিড-১৯-এ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৈন্য ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এখনো কোনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, সরকারের সঠিক কোনো পরিকল্পনা না থাকায় স্বাস্থ্য খাত এখন বেসরকারি খাতের দখলে। মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা এখন পণ্য। চিকিৎসকেরা এখন টাকার পেছনে ছোটেন। এ সংকট দূর করতে হলে আগে পরিকল্পনা করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। একটি সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুললে কোনো দিনই সংকট দূর হবে না।
গতকাল সন্ধ্যায় ৭টায় ঢাকার ইস্কাটনে সমিতির কার্যালয় থেকে এই ওয়েব সেমিনার পরিচালিত হয়। পুরো অনুষ্ঠানটি অর্থনীতি সমিতির ইউটিউব এবং ফেসবুকে পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহসম্পাদক অধ্যাপক শাহানারা বেগম। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ, সহসম্পাদক শেখ আলী আহমেদ টুটুল। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন। সেমিনার শেষে শ্রোতা-দর্শক ও আলোচকেরা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের চার দশকের গবেষণার ফসল ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা। ৭১৬ পৃষ্ঠার এ বইটি সম্পর্কে অভিনন্দন বাণী দিয়েছেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি। কৃতজ্ঞতাপত্র, মুখবন্ধ ও মোট ১২টি অধ্যায় ছাড়াও বইটিতে আছে ২৭টি সারণি, ৩৯টি লেখচিত্র, তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট।
ড. জামালউদ্দিন আহমেদ
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি