অনলাইন ডেস্ক:
দুই দশক আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সমাবেশস্থলের পাশে বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৪ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। রায়ে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলেছেন আদালত। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে প্রচলিত নিয়মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমেই এ ধরনের নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন মো. আজিজুল হক ওরফে শাহনেওয়াজ, মো. লোকমান, মো. ইউসুফ ওরফে মোছহাব মোড়ল, মোছহাব হাসান ওরফে রাশু, শেখ মো. এনামুল হক, মো. মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ, মো. মাহমুদ আজহার ওরফে মামুনুর রশিদ, মো. রাশেদুজ্জামান ওরফে শিমুল, মো. তারেক, মো. ওয়াদুদ শেখ ওরফে গাজী খান, মো. আনিসুল ইসলাম, সারোয়ার হোসেন মিয়া, মাওলানা আমিরুল ইসলাম ওরফে জেন্নাত মুন্সী ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান। দণ্ডিতরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) নেতাকর্মী।
কারাগারে থাকা সাত আসামিকে গতকাল সকালে আদালতে হাজির করা হয়। এ ছাড়া জামিনে থাকা দুই আসামি মাওলানা আমিরুল ইসলাম ওরফে জেন্নাত মুন্সী ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান আদালতে উপস্থিত হন। এই মামলার পাঁচ আসামি এখনো পলাতক। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আসামিদের এজলাসে তোলা হয়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। দণ্ডপ্রাপ্ত হাজতি আসামিদের সাজা ভোগের জন্য সাজা পরোয়ানা জারি করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ইস্যু করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। আসামিরা চাইলে এই রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে তারা দেশকে ধ্বংস করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলে ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্নভাবে তাঁকে হত্যাচেষ্টায় লিপ্ত হয়। আদালতে মুফতি হান্নানের দেওয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজি-বির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বৈধ সরকারকে উত্খাতের জন্য শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ওই বছরের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ও ৪০ কেজি ওজনের শক্তিশালী দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। সমাবেশের আগে পুলিশ ৭৬ কেজি ওজনের বোমাটি উদ্ধার করে। বারবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে হুজি। এ কারণে হুজি ও জেএমবিসহ ইসলামী জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে উল্লিখিত নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হলো।
কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ প্রাঙ্গণের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছনে (সমাবেশস্থলের পাশে) ৭৬ কেজি ওজনের ওই বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। ওই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, হত্যার ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহ এবং বিস্ফোরক আইনে কোটালীপাড়া থানায় তিনটি মামলা করে পুলিশ।
এর মধ্যে হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট হুজি-বির ১০ নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আপিলের রায়েও ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন সাজার এক আসামি এবং ১৪ বছর কারাদণ্ডের দুই আসামির সাজাও বহাল রাখা হয়েছে। ১৪ বছর সাজার এক আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
আর হত্যার ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের এই মামলায় তদন্ত শেষে ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর আদালতে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি। আদালত ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে অন্য মামলায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এই মামলায় তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে ৫০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হলে ১১ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। সেই শুনানি শেষে বিচারক রায়ের জন্য ২৩ মার্চ দিন রাখেন।
সেদিন কোটালীপাড়ায় যা ঘটেছিল
দিনটি ছিল ২০০০ সালের ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার। কোটালীপাড়ায় শেখ লুত্ফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশের প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছিল। ওই দিন সকালে স্থানীয় একজন চায়ের দোকানদার রাস্তাসংলগ্ন পুকুরে প্লেট-কেটলি ধুতে যান। এ সময় একটি প্লেট পুকুরে পড়ে গেলে সেটি তুলতে গিয়ে তিনি পানির নিচে একটি তার দেখতে পান। লম্বা ওই তার দেখে তিনি পুলিশে খবর দেন। পুলিশ ও এসএসএফ সদস্যরা এসে তার অনুসরণ করে কাঁচা রাস্তার মাটির নিচ থেকে পলিথিনে মোড়ানো শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করেন। তারের অন্য মাথা মাটি ও পুকুরের পানির মধ্য দিয়ে পুকুরের অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বোমাটির ওজন ছিল ৭৬ কেজি, উচ্চতা ১১ ইঞ্চি, ব্যাস ১৬ ইঞ্চি। এটি একটি ড্রাম আকৃতির ও ঢালাই লোহার তৈরি। এর মুখটি একটি ধাতব ঢাকনা দিয়ে শক্ত করে আটকানো।
২২ জুলাই শনিবার ছিল প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশ। এর মাত্র দুই দিন আগে জনসভার নির্ধারিত স্থান থেকে ৫০ গজ দূরে সংযোগ সড়কের মাটির নিচে লম্বা তারসহ শক্তিশালী বোমাটি পোতা ছিল। ২২ জুলাই ওই পথ দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার কথা ছিল।
কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর যে হেলিপ্যাড ব্যবহারের কথা ছিল, সেটির অবস্থানও জনসভাস্থলের পাশেই। প্রথম বোমাটি পাওয়ার দুই দিন পর ২৩ জুলাই জনসভাস্থলের পাশেই হেলিপ্যাডের পূর্ব পাশের রাস্তায় আরেকটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই দিন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ওই এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফেরার হেলিকপ্টারে ওঠার আগমুহূর্তে মাটির নিচ থেকে বের হওয়া বোমা মোড়ানো পলিথিন ও ইলেকট্রিকের তার পুলিশের নজরে আসে। ওই বোমাটির ওজন ছিল ৪০ কেজি।
এদিকে গতকালের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। রায়কে স্বাগত জানিয়ে তাঁরা বলছেন, রায় যথার্থ হয়েছে। যাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে এবং যাঁরা পলাতক, তাঁদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।