শালীনতা (Modesty) অর্থ সভ্য, ভদ্র, শোভন, সুন্দর, মার্জিত ইত্যাদি। কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ও চলাফেরায় সভ্য, ভদ্র ও মার্জিত হওয়াকে শালীনতা বলে। অর্থাৎ আচার-আচরণে ও পোশাক-পরিচ্ছদে এমন ধরন অবলম্বন করা, যাতে অন্যরা শারীরিক বা যৌন আকর্ষণে উৎসাহিত না হয়। শালীনতার পরিধি ব্যাপক, যা বহুমাত্রিক নৈতিক গুণের সমষ্টি।
ভদ্রতা, নম্রতা, সৌন্দর্য, সুুরুচি, লজ্জাশীলতা ইত্যাদির মাধ্যমে শালীনতা প্রকাশ পায়। শালীনতার বিপরীত অশালীনতা। গর্ব, অহংকার, ঔদ্ধত্য, কুরুচি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ইত্যাদি শালীনতাবিরোধী অভ্যাস।
ইসলামে শালীনতা : ইসলাম শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের ধর্ম। ইসলাম সব মানুষকে সুন্দর, সুরুচিপূর্ণ ও শালীন জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। ইসলামের সব বিধান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসনের পথ নির্দেশ করে। যেমন—ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরকালে বিশ্বাস। এতে মহান আল্লাহর কাছে পুরো জীবনের জবাবদিহিতার বিষয় জড়িত আছে। এই চেতনা মানুষকে ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালিত করে। ইবাদত-বন্দেগি মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ন্যায়বোধ সৃষ্টি করে। লেনদেন ও আচরণ-আচরণ বিষয়ক ইসলামের নীতিমালা এবং চারিত্রিক সৌন্দর্য—সরাসরি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ন্যায়বোধ বিষয়ক নির্দেশনা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমা লঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। ’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৯০)
শালীনতার মানদণ্ড : শালীনতার মানদণ্ডের বিভিন্নতা আছে। তবে সাধারণত শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ঢেকে না রাখাকে অনৈতিক এবং অশালীন বলে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই লোকসম্মুখে নগ্নতাকে অভদ্র শরীর প্রদর্শন মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের যথার্থ মানদণ্ড আছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ নারীদের নির্দেশ করে বলেন, ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৩)
লজ্জা শালীনতার সম্পূরক : শালীনতা অর্জনে লজ্জাশীলতা সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অশ্লীলতা কোনো জিনিসের কদর্যই বাড়িয়ে দেয়। আর লজ্জা কোনো জিনিসের সৌন্দর্যই বাড়িয়ে দেয়। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭৪)
এ জন্য যখন মানুষ লজ্জাহীন হয়ে যায় তখন শালীনতা ও অশালীনতার বোধটুকুও হারিয়ে ফেলে। আবু মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যখন নির্লজ্জ হয়ে পড়বে তখন যা ইচ্ছা তা-ই করবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬১২০)
শালীনতা ঈমানের অংশ : শালীনতা ঈমানের অন্যতম অংশ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ঈমানের সত্তরের বেশি শাখা আছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম শাখা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি শাখা। (মুসলিম, হাদিস : ৩৫)
এমনকি শালীনতাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি ধর্মেরই একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লজ্জাশীলতা। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৮১)
শালীনতা জান্নাতের পথ : মানব ইতিহাসের প্রথম নবী ও প্রথম মানুষ আদম (আ.) ও তাঁর সঙ্গিনী হাওয়া (আ.) জান্নাতে ছিলেন। শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ায় জান্নাতি পোশাক তাদের থেকে খুলে যায়। তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদের আবৃত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে আসতে বাধ্য হন। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তারা সেই বৃক্ষ-ফলের আস্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদের আবৃত করতে লাগল। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২২)
মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের সর্বপ্রথম আক্রমণের ফলে পোশাক খুলে যেতে থাকে। আজও শয়তান মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার পথ বেছে নেয়। ইসলাম শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচাতে অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার বিপরীতে শালীনতার নির্দেশনা দেয়। এ জন্য ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরজ হলো সতর ঢাকা। পুরুষের সতর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত আর নারীর সতর পুরো শরীর। শালীনতা ঈমানের প্রতীক। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘লজ্জা হলো ঈমানের অংশ আর ঈমানের জায়গা জান্নাত। অশ্লীলতা হলো জুলুম আর জুলুমের জায়গা জাহান্নাম। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০০৯)
পরিশেষে বলা যায়, শালীনতা ঈমান, ইসলাম ও মানবতার প্রতীক। কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ও চলাফেরায় শালীনতার অভ্যাস গড়ে উঠলে জান্নাতের পথ সুগম হবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়