অনলাইন ডেস্কঃ
আমি ১৯৫৬ সালে ঢাকায় এসে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। জগন্নাথ কলেজ তখন ঢাকার একটি পুরনো কলেজ এবং বিখ্যাতও বটে। ছাত্রসংখ্যাও অনেক। এ কলেজের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, ছাত্ররা খুবই রাজনৈতিক সচেতন।
এক বছর যাওয়ার পর পূর্ব বাংলায় তখন রাজনৈতিক আন্দোলন তীব্র। বঙ্গবন্ধু তখনো বঙ্গবন্ধু হননি, শেখ মুজিবুর রহমান—তরুণ জনপ্রিয় নেতা। ১৯৫৭ সালের দিকে একটি ভুখ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে তিনি নদীর ওপার থেকে লাঙল কাঁধে নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। মিছিলটি শুরু হয়েছিল সদরঘাট থেকে। লক্ষ ছিল চকবাজার পর্যন্ত। সদরঘাটের পাশেই জগন্নাথ কলেজ। শেখ মুজিবুর রহমান ভুখ মিছিলে অংশগ্রহণ করছেন—এ খবর পেয়ে জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা সদরঘাটে এসে জমায়েত হলো। আমিও এর সঙ্গে যুক্ত হলাম। শেখ মুজিব একটি অগ্নিগর্ভ ভাষণ দিলেন। বললেন, ‘পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। খাদ্যের তীব্র সংকট। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।’ যত দূর মনে পড়ে, আবু হোসেন সরকার তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। একটি অসাধারণ বক্তৃতার পর ভুখ মিছিল শুরু হলো। শেখ মুজিব নেতৃত্ব দিলেন। সঙ্গে আমরাও যেতে থাকলাম। সদরঘাট থেকে ইসলামপুর, ইসলামপুর হয়ে বাবুবাজার, তারপর চকবাজারের দিকে যেতে থাকলাম। ভুখ মিছিলটি যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস এবং তারপর গুলিবর্ষণ করে। এতে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ইকবাল আহত হয়। ইকবালকে সলিমুল্লাহ মুসলিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমরা সেখানে গেলাম। উদ্বিগ্ন হয়ে ছোটাছুটি করছি। এমন সময় দেখা গেল শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি তো জনগণের খাদ্যের দাবিতে একটি আন্দোলন পরিচালনা করছিলাম। একটি ভুখ মিছিল বেরিয়েছে। আমরা কারো কোনো প্রতিপক্ষ ছিলাম না। সেখানে এই স্বৈরাচারী সরকার গুলিবর্ষণ করল? একটি তরুণ ছাত্রকে গুলি করে আহত করল? এর চেয়ে দুঃখের, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে? দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু আমাদের খাদ্যের অধিকার নাই। মানবিক অধিকার নাই। আইন-শৃঙ্খলার কোনো বালাই নাই।’ আমরা সবাই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। তিনি বললেন, ‘উত্তেজিত হয়ো না তোমরা, শান্ত থাকো। ছাত্র ভাইটির যাতে চিকিৎসা হয় সে ব্যবস্থা করো।’ তিনি ডাক্তারদের সঙ্গেও কথা বললেন। আহতকে তখন রক্ত দেওয়া হচ্ছে। দু-তিন দিন পর সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
এই প্রথম আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখলাম। তিনি যে অনলবর্ষী বক্তা তারও পরিচয় পেলাম। সেই সঙ্গে তাঁর মানবিক বোধের যে তীক্ষতা সেটিও লক্ষ করলাম।
দ্বিতীয়বার আবার তাঁকে দেখি সেই সদরঘাটে। শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগ অফিসে আসবেন। আওয়ামী লীগ অফিস তখন সদরঘাটের সিমসন রোডে। তাঁর গাড়িটি সদরঘাটের মল্লিক ব্রাদার্সের কাছে এসে থামল। লম্বা-তুখোড় মানুষটি গাড়ি থেকে নামলেন। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা। ড্রাইভার জানতে চাইল, ‘গাড়ি নিয়ে কি আরো সামনের দিকে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে যাব?’ তিনি বললেন, ‘না না, গাড়ি এখানেই রাখো, আর সামনে যাবে না।’ সদরঘাটের পুরো রাস্তায় তখন হকাররা বসত। তিনি বললেন, ‘গাড়ি ওখানে যেতে গেলে হকারদের রাস্তা থেকে উঠতে হবে। আমি চাই না মানুষের কষ্ট হোক। আমি এইটুকু হেঁটে যেতে পারব।’ পুলিশকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসার কোনোই দরকার নাই।’ তাঁর অফিসের একজন কর্মকর্তা সঙ্গে ছিলেন, তাঁকে নিয়েই তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
এই দুইবার তাঁকে দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের এই নেতা কতটা মানবপ্রেমিক, কতটা মহান। তাঁর প্রথম জীবনেই এই যে মানবপ্রেম, এই যে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষকে কষ্ট না দেওয়া, দেশের মানুষকে নিজের মানুষ ভাবা—এটাই ছিল পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো নেতার মতো কোনো কৃত্রিম ভাব অথবা অস্বচ্ছ চিন্তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাজনীতি করেননি।
আজীবন তিনি রাজনীতি করেছেন ইতিহাসের বোধের ওপর দাঁড়িয়ে। এ জন্যই তিনি এক অসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতা হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁকে বছরের পর বছর যেমন জেল খাটতে হয়েছে, তেমনি বাংলার মানুষকেও বহু অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ৩০ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই দেশটিকে স্বাধীন করা সম্ভব হয়ে উঠেছিল।
আমাদের দুর্ভাগ্য, ঘাতক, বিশ্বাসঘাতক, বেইমান ও দেশদ্রোহীরা তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুর পৈশাচিকতায় হত্যা করেছে। আমরা এই পৈশাচিক দুর্বৃত্তদের ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর শহীদ হওয়ার মাসে আমাদের শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সভাপতি, বাংলা একাডেমি।