অনলাইন ডেস্ক:
১৯৭৫ সালের জুন মাসের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তখন আমি স্ত্রীর চিকিৎসা উপলক্ষে ঢাকা থেকে লন্ডনে এসেছি এবং লন্ডনে থাকি। মাস দেড়েকের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। সম্ভবত মে মাস হবে। বাংলাদেশে প্রচণ্ড গরমের সময়। লন্ডন থেকে ঢাকা পৌঁছে সহসা অস্বস্তিতে পড়তে হয়। ঢাকায় আমার বাসা ছিল কে এম দাস লেনে। একদিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধু সন্দর্শনে গেলাম। সঙ্গে ছিল পাঁচ প্যাকেট সল্টেড বিস্কুট, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ব্র্যান্ডের বিস্কুট আর এরিনমোর টোব্যাকো। বিলাত থেকে এসেছি। এ দুটি জিনিস সঙ্গে নিয়ে না এলে বঙ্গবন্ধু রাগ করেন।
তখন তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে প্লেন অবতরণ করত। বিমানবন্দরে নেমে কপালের দোষে কিনা জানি না, খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘বউমা কেমন আছে?’ বললাম, ‘চিকিৎসা চলছে।’ মোশতাক আহমদের সঙ্গে বড় দুটি প্যাকেট দেখে বললাম, ‘মোশতাক ভাই, এসব কী?’ তিনি হেসে বললেন, ‘খেজুরের প্যাকেট। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন লিডারকে (বঙ্গবন্ধু) পাঠিয়েছেন। আমি তো বাগদাদ থেকে ফিরলাম।’
পরদিনই নতুন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব রহিম সাহেব খুব আদর-যত্ন করে তাঁর ঘরে বসালেন। বন্ধু মোহাম্মদ হানিফ (পরবর্তীকালে ঢাকার মেয়র) সে ঘরে ছিলেন।
বললেন, ‘গাফ্ফার ভাই, লিডার জাপানের ট্রেড মিশনের সঙ্গে কথা বলছেন, এখনই ফ্রি হবেন।’ রহিম সাহেবের কক্ষে চা খেতে না খেতেই বঙ্গবন্ধুর কাছে ডাক পড়ল।
এমনটা কখনো হয় না। বঙ্গবন্ধু তাঁর কক্ষের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ওয়েলকাম, ব্যাক টু বাংলাদেশ। বউমা কেমন আছে?’ বললাম, ‘তার চিকিৎসা চলছে।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অনেক দিন পরে তো দেশে ফিরলে, কেমন লাগছে?’ বললাম, ‘দেশ তো ভালো লাগছে; কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো লাগছে না। আমি ঢাকায় পৌঁছেই বন্ধু-বান্ধবের কাছে দেশের খবরবার্তা নিয়েছিলাম। সবার কণ্ঠে এক কথা, একটা বিপদসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমাকে টেনে পাশে সোফায় বসালেন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘গাফ্ফার, চারদিকে ষড়যন্ত্র। তার ওপর চারদিকে চাটার দল এসে জুটেছে। ভিক্ষে করে বিদেশ থেকে যা আনি, চেটেপুটে তা খেয়ে ফেলে। আমার গরিব মানুষ তা পায় না।’
হঠাৎ সোফা ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চোখে-মুখে উত্তেজনা। বললেন, ‘গাফ্ফার, আই হ্যাভ ক্রিয়েটেড আ হিস্ট্রি, আই ক্যান নট লিভ ইট আনফিনিশড। ইফ আই ফেইল, দ্যান আই উইল গো টু অবলিভিয়ন ফর আ লং টাইম।’ ইংরেজিতে এ কথাটা বলে তিনি আবার সোফায় বসলেন। আমি তাঁর মনের অবস্থা টের পাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড আবেগের ঝড় বইছে তাঁর মনে।
আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য বললাম, ‘আমি আপনাকে লন্ডন থেকে দীর্ঘ চৌদ্দ পৃষ্ঠার একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। চিঠি পড়ে আপনি কি রাগ করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি তো তোমার কোনো চিঠি পাইনি। কার মারফত পাঠিয়েছিলে?’ বললাম, ‘ড. কামাল হোসেনের মারফত। তিনি লন্ডন থেকে ঢাকা আসছিলেন। আমি তাঁকেই চিঠিটা দিয়েছি।’ বঙ্গবন্ধু বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘কই, কামাল তো আমাকে কোনো চিঠি দেয়নি!’ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কী লিখেছিলে তাতে?’ আমি জবাব দিতে কিছুক্ষণ চুপ থেকেছিলাম। তারপর বলেছি, ‘চিঠিটা সেই জানুয়ারি মাসের দিকে লেখা। আপনি এখন চিঠির বয়ান শুনে রাগ করতে পারেন।’
বঙ্গবন্ধু বিষণ্ন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি রাগ করলেই কি তুমি আমার কথা শুনতে? মানিক ভাই মারা যাওয়ার পর তোমার ওপর নির্ভর করেছিলাম। কিন্তু তুমিও মাঝে মাঝে ফাউল গেম খেলো।’ আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, ‘কী লিখেছিলে চিঠিতে?’ তিনি কতটা রেগে যাবেন তা বুঝতে না পেরে ধীরে ধীরে বলেছি, লিখেছিলাম, এই সময় আপনার বাকশাল গঠন করা ঠিক হবে না। লন্ডনে গিয়ে বিভিন্ন মহলের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে একটা প্রবল শক্তিশালী শত্রুপক্ষ অপেক্ষা করছে। আপনি বাকশাল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তারা তৎপর হবে। আপনি গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে এক ব্যক্তির শাসন প্রবর্তন করেছেন—এবার এটাই হবে মুখ্য প্রচারণা। এখন দেখা যাচ্ছে তাই হচ্ছে। ভুট্টো ঢাকা সফরে এসে ওল্ড মুসলিম লীগার ও জামায়াতিদের সংঘবদ্ধ করছেন। আমাদের আর্মিতেও তারা ইনফ্লিট্রেন্ট করেছে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘লন্ডনে এসব খবর তোমাকে কে দিয়েছিল?’ বললাম, মজহার আলী, বিহারি সাংবাদিক। ঢাকায় আপনার বন্ধু ছিলেন। করাচিতে চলে গিয়েছিলেন। গিয়ে ভুট্টোর কোপে পড়েন। লন্ডনে পালিয়ে এসে গ্রিন ক্রিসেন্ট নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করেন। তাতে ভুট্টোর বিরুদ্ধে গালাগালি থাকে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মাজহারকে আমি চিনেছি।’ বলেই তিনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোমার চিঠিটা আমার পাওয়া উচিত ছিল। কামাল আমাকে চিঠিটা দিল না কেন?’ বলেই তিনি ঠোঁট কামড়ালেন। বললেন, ‘দুপুরে আমার সঙ্গে ভাত খেয়ে যাবে। চলো, টেবিলে চলো।’
সেদিন খেতে বসে তেমন কথাবার্তা আর হয়নি। লন্ডনের দ্রব্যমূল্য, উইনসনের আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পেছনে কোনো রহস্য ছিল কি না, বাকশালে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে নিতে চেয়েছিলেন, সে জন্য মনোরঞ্জন ধরকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু তাজউদ্দীন রাজি হননি ইত্যাদি।
খাওয়া শেষ হলে তিনি শোবার রুমে সাদা চাদরে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়লেন। বললেন, ‘কদিন দেশে আছ?’ বললাম, ‘দিন পনেরো আছি।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে আবার এসো।’ আমি তাঁর শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছি। লন্ডন থেকে দ্বিতীয়বার দেশে ফিরে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই আমার প্রথম সাক্ষাৎকার। কিছুদিন পর লন্ডনে ফেরার জন্য যখন তাঁর কাছে গেছি, তখন নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের ট্রেনিং দান তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আমি বিদায় চাইতে গেলে বলেছিলেন, ‘এসো, তারপর আমার হাতটা চেপে ধরে বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি বউমাকে নিয়ে ফিরে এসো।’
সেদিনই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সেদিন জানতাম না আর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে না।
লেখক: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী,লন্ডন, শনিবার, ৩১ জুলাই ২০২১