কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানকারী বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা শুধু সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটক সিম ব্যবহার করতে পারবে। রেশন কার্ড অথবা এফসিএনের (ফ্যামিলি কাউন্টিং নম্বর) মাধ্যমে প্রতিটি পরিবার একটি করে সিম পাবে। তারা দেশের অন্য কোনো মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করতে পারবে না। ক্যাম্প এলাকায় এবং সংশ্লিষ্ট সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের এসব নাগরিক অনেকে দুই দেশের সিম ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে মাদক ব্যবসা, অপহরণ, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের কাছে মোবাইল ফোনের সিম বিক্রিসংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’র প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তাফা জামানের সভাপতিত্বে ওই সভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), আইন ও বিচার বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই সভায় বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দুই-তিনটি অপারেটরের সিম ব্যবহার করে। বাংলাদেশের সিম ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা স্থানীয়দের মাধ্যমে নিবন্ধন করে। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। ভিনদেশি মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করার কারণে তাদের গতিবিধি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর। এ অবস্থায় তাদের বাংলাদেশি মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের আওতায় আনা এবং তাদের মিয়ানমারের সিম ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বাংলাদেশের যেকোনো একটি মোবাইল অপারেটরের কাভারেজের আওতায় আনা প্রয়োজন।
সভায় সীমান্তে জ্যামার বসিয়ে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক দুর্বল করা সম্ভব কি না—সে বিষয়েও আলোচনা হয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে বলা হয়, এটি ব্যয়বহুল। এর জন্য এক হাজার ১০০টি জ্যামার প্রয়োজন হবে এবং প্রতিটি জ্যামারের মূল্য আনুমানিক দুই কোটি টাকা হিসাবে প্রয়োজন হবে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বিটিআরসির পক্ষেও বলা হয়, সীমান্তে জ্যামার বসিয়ে কোনো দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করা বেশ জটিল এবং বাস্তবতার নিরিখে প্রায় অসম্ভব।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে বলা হয়, বিটিআরসির বিদ্যমান নীতিমালায় জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কারো কাছে মোবাইল ফোনের সিম বিক্রির সুযোগ নেই। ক্যাম্পের বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা অবৈধভাবে স্থানীয়দের নামে নিবন্ধন করে বাংলাদেশের মোবাইল সিম ব্যবহার করছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের মোবাইল ফোন অপারেটরদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হওয়ার কারণে এবং মিয়ানমারে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজন, মাদকসহ ব্যাবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সে দেশের সিম ব্যবহার করছে তারা। এ অবস্থায় নতুন সিম ব্যবহারে তাদের অভ্যস্ত করানোও কঠিন হবে। আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে বলা হয়, ক্যাম্পের বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা বর্তমানে দেশের যেসব অপারেটরের সিম ব্যবহার করছে সেগুলো বাতিল করতে হবে এবং মিয়ানমারের তুলনায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে হবে। না হলে নতুন সিম ব্যবহারে তাদের অভ্যস্ত করা কষ্টসাধ্য হবে।
সভায় শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিনিধি বলেন, ইউএনএইচসিআরের ডাটাবেইস ব্যবহার করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত পরিবারগুলোকে সিম দিতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তিনি রেশন কার্ড অথবা এফসিএনের (ফ্যামিলি কাউন্টিং নম্বর) বিপরীতে পরিবার পিছু একটি করে সিম বিক্রির প্রস্তাব রাখেন এবং এই প্রস্তাব সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এ ছাড়া সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মধ্যে টেলিকটের সিম বিক্রি করা হবে।
এদিকে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরদের মত হচ্ছে, এটি বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ প্রতিযোগিতা আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া নিরাপত্তাগত দিক থেকে টেলিটকের তুলনায় বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের সক্ষমতা অনেক বেশি। গতকাল দুটি বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের কাছ থেকে এই মত পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা বিটিআরসি থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে কোনো এলাকায় একটি মাত্র মোবাইল অপারেটরের সিম বিক্রির বিষয়টি বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
রবির পক্ষে বলা হয়, ‘টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার প্রতিযোগিতা ক্ষুণ্ন হয়—এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিনীত অনুরোধ জানাই।’