বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী প্রায়ই বেসরকারি কম্পানি, ধনী ব্যক্তি এবং রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে যানবাহন থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত বিভিন্ন অনুদান গ্রহণ করে। অনুদান দেওয়া ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই আবার ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে এই অনুদান প্রয়োজনীয় বলে বাহিনীটি দাবি করলেও, সমালোচকদের মতে এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরপেক্ষতার সঙ্গে আপস এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, পুলিশ যখন বহিরাগত দাতাদের ওপর নির্ভর করে- বিশেষ করে যাদের স্বার্থ রয়েছে, এটি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি ও গুরুতর নৈতিক উদ্বেগের জন্ম দেয়।
পুলিশ বাহিনীতে প্রতিবছর সরকারি অর্থায়নের বিষয়ে জোর দিয়ে সহকারী মহাপরিদর্শক ও পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এনামুল হক সাগর বলেন, এটা সত্য যে কিছু সংস্থা স্বেচ্ছায় যানবাহন এবং ট্রাফিক পুলিশ বক্স প্রদান করে। তবে বেসরকারি সত্তা থেকে লজিস্টিক সহায়তা গ্রহণ করলে পুলিশের নিরপেক্ষতার সঙ্গে আপস করা হয় না।
তবে অতীতের ঘটনা অবশ্য ভিন্ন কথাই বলে। ২০২১ সালে রাজবাড়ীর পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের কাছ থেকে একটি গাড়ি অনুদান নেয়। জিল্লুল হাকিম এখন একাধিক মামলার আসামি। ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান থেকে গাড়ি অনুদান নেয়। সেলিম ওসমানের পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০২৩ সালে কক্সবাজারের একটি পুলিশ ক্যাম্প আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শাইমুম সরওয়ার কমলের কাছ থেকে একটি গাড়ি অনুদান নেয়। তিনি জমি দখল এবং আর্থিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত।
পুলিশের ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, বাহিনীটির কাছে ১০ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন ছিল। কিন্তু তাদের কমপক্ষে ১৬ হাজার ১২৪টি যানবাহনের প্রয়োজন ছিল। এ সময় মোটরসাইকেলসহ পাঁচ হাজার ১৭৬টিরও বেশি যানবাহনের ঘাটতি ছিল বাহিনীটিতে। গেল বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুলিশের এক হাজার ৭৪টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এরপর মাত্র ৪০০ নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। ফলে পুলিশ বেসরকারি গাড়ির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়।
এ বছরের ২৩ জানুয়ারি রানার গ্রুপ ডিএমপিকে পাঁচটি মোটরসাইকেল এবং একটি পিকআপ ভ্যান দান করে। সে সময় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, এই যানবাহনগুলো টহল সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। অরিক্স গ্রুপের মতো অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ বুথসহ পুলিশ অবকাঠামোতে অর্থায়ন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ব্যক্তিগত অনুদানের ওপর ক্রমাগত নির্ভরতা ধনী ব্যক্তি এবং করপোরেশনগুলোকে আইন প্রয়োগকারী সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতা দেবে। আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে পুলিশ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পরিবর্তে অভিজাতদের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। পুলিশের মতো জরুরি পরিষেবার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. জারিফ রহমান বলেন, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণের অনুমতি না দিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত পুলিশি সুরক্ষা পেতে আর্থিক সহায়তা দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। তিনি আরো বলেন, আমরা দেখেছি পুলিশের বাজেটে শুধু বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেই বেড়েছে। আমরা পুলিশকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক যানবাহন সরবরাহ করার সুপারিশ করেছি, যাতে তাদের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সংস্থার ওপর নির্ভর করতে না হয়।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
সূত্র : ডেইলি সান