আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আরেকটি লজ্জার নজির গড়লেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হলেন তিনি। সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গত বুধবার মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে তাঁকে অভিশংসন করার প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন তাঁর নিজ দলের কয়েকজন আইন প্রণেতাও।
ভোটের পর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেন, ‘পার্লামেন্ট আরেকবার প্রমাণ করে দেখাল যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও।’
অভিশংসনের এই প্রস্তাব এবার উঠবে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে। সেখানে ট্রাম্পের ভাগ্যে কী ঘটবে তা এখনো অনিশ্চিত। ট্রাম্পের জন্য স্বস্তির খবর এতটুকুই যে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হচ্ছে না। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেওয়ার আগে অভিশংসন নিয়ে ভোটাভুটির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সিনেটপ্রধান মিচ ম্যাককনেল। আর ট্রাম্পের জন্য অস্বস্তির খবর হলো—সিনেটে অভিযুক্ত হলে তাঁর আরেকবার নির্বাচনে লড়ার স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যেতে পারে।
যেভাবে দ্বিতীয় অভিশংসন
আগামী ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন জো বাইডেন। গত ৬ জানুয়ারি তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতি দেয় কংগ্রেস। ওই দিন ট্রাম্পের আহ্বানে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে হামলা চালায় তাঁর সমর্থকরা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর পাশাপাশি কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ঢুকে প্রায় চার ঘণ্টা ভাঙচুর চালায় তারা। এ ঘটনায় নিহত হয় পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন। ঘটনার পর বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা দাবি তোলে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্পকে অপসারণ করা হোক। এই দাবির প্রতি সমর্থন জানান ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের অনেক আইন প্রণেতাও। ট্রাম্পকে সরাতে দুটি পদ্ধতি হাতে ছিল ডেমোক্র্যাটদের। প্রথম চেষ্টায় সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী কার্যকর করে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে অনুরোধ জানান তাঁরা। কিন্তু পেন্স তাতে অস্বীকৃতি জানান। তখন বিকল্প হিসেবে অভিশংসনের প্রস্তাব নিয়ে গত বুধবার পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হয়। আর সেই ভোটেই অভিশংসিত হন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনো প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হননি। এর আগে ২০১৯ সালে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হন ট্রাম্প। কিন্তু সিনেটে তিনি দায়মুক্তি পেয়ে যান।
প্রস্তাবে যা বলা আছে
অভিশংসনের অভিযোগ রাজনৈতিক, ফৌজদারি নয়। এবারের অভিশংসনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার নির্বাচনে কারচুপির মিথ্যা অভিযোগ করে আসছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরপর জনগণের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি স্বেচ্ছাচারীর মতো একই অভিযোগ তোলেন। এ ছাড়া তিনি কর্মী-সমর্থকদের কংগ্রেস ভবনে যাওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর ওই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জানুয়ারি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে এবং কয়েকজনকে প্রাণ হারাতে হয়।’ প্রস্তাবে আরো বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের অখণ্ডতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলে হস্তক্ষেপ করেছেন।’
বুধবারের ভোটাভুটিতে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন ২৩২ জন। বিপক্ষে ভোট পড়ে ১৯৭টি। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের ১০ আইন প্রণেতাও। তাঁদের একজন অ্যাডাম কিনজিংগার। তিনি বলেন, ‘এটা ভেবে শান্তি পাচ্ছি যে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি।’
এরপর যা ঘটতে পারে
অভিশংসনের এই প্রস্তাব সিনেটে তোলা হবে। সিনেটের সদস্যসংখ্যা ১০০ জন। সেখানে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করতে হলে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ, অন্তত ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরকে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে হবে। গত মঙ্গলবার নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০ জন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিতে রাজি আছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিনেটে অভিযুক্ত হলে আইন প্রণেতারা আরেকটি প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি করতে পারবেন। ওই প্রস্তাব পাস হলে ট্রাম্প ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচন করতে পারবেন না। এমনকি সরকারি কোনো পদে তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। তবে ২০ জানুয়ারির আগে সিনেটে কোনো ভোটাভুটির সম্ভাবনা নেই। সিনেটপ্রধান মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, অভিশংসন নিয়ে পড়ে না থেকে আইন প্রণেতাদের উচিত হবে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করা। ২০ জানুয়ারির পর ভোটাভুটিতে কোনো বাধা নেই বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
ট্রাম্প-বাইডেনের প্রতিক্রিয়া
অভিশংসন নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি ট্রাম্প। তবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এক ভিডিওবার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের দেশে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমার সত্যিকারের কোনো সমর্থক সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারে না।’ ট্রাম্পপন্থীরা ২০ জানুয়ারির আগে দেশজুড়ে সশস্ত্র বিক্ষোভ করতে পারে—এফবিআইয়ের এমন সতর্কতার পর এই বার্তা দিলেন ট্রাম্প।
এদিকে বুধবারের ভোটের ফলকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বাইডেন। তবে শুধু অভিশংসন নিয়ে পড়ে না থাকতে আইন প্রণেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করব, সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে আইন প্রণেতারা অভিশংসনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন। তবে নতুন মন্ত্রিসভা ও করোনা মহামারির প্রণোদনা অনুমোদনের বিষয়গুলোর প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।’
সামরিক সদস্যদের জন্য সতর্কবার্তা
মার্কিন সামরিক বাহিনী সাধারণত রাজনীতি এড়িয়ে চলে। কিন্তু ৬ জানুয়ারির ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন সাবেক এবং বর্তমান সেনা সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে উদ্বেগ তৈরি হয়। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে পেন্টাগনের ওপর চাপ তৈরি করে ডেমোক্র্যাটরাও। এ অবস্থায় স্থল, নৌ, বিমানবাহিনীসহ মার্কিন সামরিক বাহিনীর সব শাখার শীর্ষ কমান্ডাররা যৌথভাবে সব সেনা সদস্যের প্রতি একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ক্যাপিটল ভবনে হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ওপর সরাসরি হামলা।’
সূত্র : বিবিসি, এএফপি।