ধর্ম ডেস্ক:
রমজান মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণকাল। এ মাসে মুমিন বিনীত প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভ করে এবং সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একটি পবিত্র জীবনের দীক্ষা গ্রহণ করে, যে জীবনের মূল পাথেয় আল্লাহভীতি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
রমজান পরিবর্তনের মাস : রমজান পরিবর্তনের মাস। এ মাসে আল্লাহ বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর চিরায়ত অনেক নিয়মেও পরিবর্তন আনেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজান এলে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দি করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৯৮)
জীবনে আমূল পরিবর্তনই কাম্য : রমজানের দাবি হলো, বান্দা তার জীবনের আমূল পরিবর্তন আনবে এবং তার সব মন্দ অভ্যাস পরিহার করবে, যেন সে রমজানে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভ করতে পারে। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘যখন তুমি রোজা রাখো, তখন যেন তোমার কান, চোখ ও জিহ্বা মিথ্যা ও পাপ থেকে রোজা রাখে (বিরত থাকে)। সেবককে কষ্ট দেওয়া ছেড়ে দাও। রোজার দিনে তোমার ওপর যেন স্থিতি ও প্রশান্তি প্রকাশ পায়। তোমার রোজা রাখা দিন ও না রাখা দিন যেন এক হয়ে না যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২/২৭১)
জাবির (রা.)-এর নির্দেশনার কারণ হলো পরকালে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিপদের কারণ হবে—যদি না তা পাপমুক্ত হতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আজ তাদের মুখ বন্ধ করে দেব। তাদের হাত কথা বলবে আমার সঙ্গে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৬৫)
পরিবর্তনহীন রোজা নিষ্ফল : যে ব্যক্তির রোজা তার দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে না, যা মানুষের নিত্যদিনের পাপ পরিহারে ভূমিকা রাখে না সে রোজা নিষ্ফল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘কত রোজাদার এমন, যাদের রোজা ক্ষুিপপাসা ছাড়া আর কিছুই না এবং কত তাহাজ্জুদ আদায়কারী এমন, যাদের তাহাজ্জুদ রাত জাগা ছাড়া আর কিছু না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২০১৪)
পরিবর্তনের তিন নিদর্শন : রমজানে কোনো মুমিন নিজের ভেতর পরিবর্তন আনতে পারল কি না, তা বোঝা যায় তার পরবর্তী সময়ের আমল ও আচরণ দ্বারা। ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘রমজানের রোজা কবুল হওয়ার লক্ষণ হলো রমজানের পর পুনরায় রোজা রাখতে সক্ষম হওয়া। কেননা আল্লাহ যখন কোনো বান্দার আমল কবুল করেন, তখন তাকে সে আমল পুনরায় করার তাওফিক দেন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২২১)
রমজানের রোজা কবুল হওয়া এবং তার প্রধান লক্ষ্য ‘তাকওয়া’ (আল্লাহভীতি) অর্জনের নিদর্শন তিনটি—এক. আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে একনিষ্ঠ হওয়া, দুই. পাপ কাজে অনীহা ও ভালো কাজে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া, তিন. ভালো কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারা। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২১৫)
পূর্বসূরি আলেমদের উদ্বেগ : রমজানের রোজা কবুল হওয়া তথা রমজান ফলপ্রসূ হলো কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন পূর্বসূরি বুজুর্গরা। বিশেষত রমজানের শেষভাগে তাঁদের উদ্বেগ বেড়ে যেত। রমজানের শেষভাগে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘আমাদের মধ্যে কার রোজা কবুল হলো, আমরা তাকে অভিনন্দন জানাব এবং কে বঞ্চিত হলো, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করব। হে সৌভাগ্যবান! যার রোজা কবুল হয়েছে তোমাকে অভিনন্দন এবং হে হতভাগা! যার রোজা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে আল্লাহ তোমার পাপ মার্জনা করুন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২১০)
শেষ দশক ফসল ঘরে তোলার সময় : পুরো রমজান মাসই মুমিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে শেষ দশকের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এটা পবিত্র রমজানের ফসল ঘরে তোলার সময়। কেননা বেশির ভাগ আলেমের মতে, এ দশকেই রয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদরের রাত। কোরআনের ভাষ্য মতে যে রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে। আর মহিমান্বিত রাত সম্পর্কে তুমি কি জানো? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৩)
মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগিতে আরো বেশি মনোযোগী হতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন, রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
ফুরিয়ে যাচ্ছে সময় : রমজানের শেষ দশক চলছে। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে নিজেকে পাপমুক্ত করার সময়। এখনো যদি নিজেকে পরিশুদ্ধ করা না যায় এবং আল্লাহর ক্ষমা সৌভাগ্যে না হয়, তবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংস। কেননা জিবরাইল (আ.) সেসব মানুষের ধ্বংসের দোয়া করেছেন, যারা রমজান পেয়েও নিজেকে পাপমুক্ত করতে পারেনি এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দোয়ার পর আমিন বলেছেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৮৮)
অপর বর্ণনায় মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলোধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)
আল্লাহ সবাইকে রমজানের ক্ষমা, অনুগ্রহ ও বরকত নসিব করুন এবং রমজানের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনে পরিবর্তন আনার তাওফিক দিন। আমিন।