ধর্ম ডেস্ক:
খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জুবাইদা। তিনি হাজিদের খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করতে খাল খনন করেন, যা বিশ্বে নহর-এ-জুবাইদা হিসেবে বিখ্যাত; যার অর্থ জুবাইদার খাল। নাহর অর্থ সরু, স্রোতস্বিনী, জলধারা, খাল, নালা ইত্যাদি। আব্বাসীয় খলিফারা শত শত বছর বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করে গেছেন, যার মধ্যে জাজিরাতুল আরব তথা বর্তমান সৌদি আরবও ছিল।
মরুপ্রবণ পবিত্র মক্কায় জমজমের পানি ছাড়া তেমন পানির উৎস ছিল না। ফলে হাজিরা সেকালে সুপেয় পানির অভাবে কষ্ট পেতেন। বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আল-মনসুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাফরের কন্যা ছিলেন জুবাইদা। সম্পর্কে চাচাতো বোন জুবাইদাকে বিয়ে করেন খলিফা হারুনুর রশিদ। কিংবদন্তি আছে—রানি জুবাইদা একরাতে স্বপ্ন দেখেন অসংখ্য পুরুষ তাঁর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর তিনি খুব বিব্রত বোধ করছিলেন। এক বিচক্ষণ দাসীকে তাঁর স্বপ্ন বলে শিখিয়ে দিয়ে বাগদাদের বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য। দাসী থেকে স্বপ্নের কথা শুনে ধর্মীয় ব্যক্তি বললেন, ‘এটি তোমার স্বপ্ন হতে পারে না। স্বপ্ন কার তুমি আগে খুলে বলো, তারপর আমি ব্যাখ্যা দেব।’ সব কিছু খুলে বলার পর ব্যাখ্যাকার বলেন, রানি জুবাইদা এমন কাজ করবেন, যাতে অগণিত মানুষ উপকৃত হবে।
১৯৩ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিল যে এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা হারুনুর রশিদ কর্তৃক পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হাজিদের পানির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারল না। ১৯৩ হিজরিতে তাঁর মৃত্যুর পর রানি জুবাইদা হজব্রত পালনে গেলেন। পবিত্র মক্কায় পানির সমস্যা দেখে তাঁকে এতই ব্যথিত করেছিল যে পানির সমস্যা চির অবসানের জন্য একটি খাল খননের তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মক্কায় আগত হাজিদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পানির ব্যবস্থা করেন। মুয়াবিয়া (রা.) তা আরো সম্প্রসারিত করেন।
রানি জুবাইদা খাল খননের সময় জনগণের উদ্দেশে বললেন, ‘খাল খননের নিমিত্তে আমি সব হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছি। যাদের কাছে আমি টাকা পাব সে টাকা পরিশোধ করতে হবে না এবং আমি যাদের কাছে ঋণী, তাদের ঋণ অতিসত্বর দ্বিগুণ হারে পরিশোধ করা হবে।’ অতঃপর তিনি হাজিদের কল্যাণে পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত একটি খাল খননের আদেশ দেন। হাজার বছর ধরে এই খাল দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
এ ছাড়া রানি জুবাইদা কুফা থেকে পবিত্র মদিনা ও পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত মরুভূমির ওপর দিয়ে প্রায় এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের উন্নয়ন সাধন করেছিলেন, যা হজযাত্রীরা ব্যবহার করতেন। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা বাগদাদভিত্তিক আব্বাসীয়দের শাসনাধীন ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে আব্বাসীয় শাসকরা বাগদাদের সঙ্গে এই পবিত্র নগরীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার, মঞ্জিলে নানা সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অর্থ ব্যয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রাচীনকালে দিনে বিশ্রাম, রাতে যাতায়াতের প্রচলন ছিল। সাধারণ নিয়মে এক রাতে ১৬ মাইল পর্যন্ত যাওয়া যেত। ১৬ মাইল পর বিশ্রাম অবস্থানকে বলা হতো মঞ্জিল। রানি জুবাইদা বাগদাদ থেকে পবিত্র এই দুই নগরীতে যাওয়ার মঞ্জিলগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। সঙ্গে উট, গাধা, ঘোড়া যাতায়াতে সুবিধার জন্য সমতলে বালু সরিয়ে এবং পাহাড়-পর্বত কেটে সড়ক সংস্কার করেন।
রানি জুবাইদা খাল খননের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ারদের ডেকে পাঠান। সমগ্র এলাকা জরিপ করার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত দেন হুনায়ন—পবিত্র মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলের উপত্যকার পার্বত্য ঝরনা, যা সেখানকার অধিবাসীদের পানীয় জল, সেচের জলের প্রয়োজন মেটাত, সেখান থেকে খালটি খনন করে আনা হবে। এই অঞ্চলটি কঙ্করময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং এর আবহাওয়া উষ্ণ। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে একটি খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিল। তাই প্রকৌশলীরা টানেলের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ খাল খননের পরিকল্পনা করেন, জনগণ যাতে এই খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে এর জন্য কিছুদূর অন্তর অন্তর ভূ-পৃষ্ঠে পানির স্টেশন স্থাপন করা হয়। হুনায়ন উপত্যকার ঝরনার পানি এবং পথিমধ্যে অন্যান্য উৎসকে এই নহর অভিমুখে এনে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। রানি জুবাইদার নির্দেশে হুনায়ন উপত্যকার ঝরনার পানির অন্যান্য উৎস বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরদাম অর্থ পরিশোধ করব।’ বহু বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে জাবাল-ই-রামা তথা দোয়ার পর্বত পেরিয়ে এই নহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর নিয়ে আসা হয় মুজদালিফা ও মিনায়।
২৪৫ হিজরিতে পবিত্র মক্কা এলাকায় ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে নহর-এ-জুবাইদার বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। তৎকালীন খলিফার নির্দেশে তাত্ক্ষণিকভাবে তা মেরামত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজন শাসক নহর-এ-জুবাইদার উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। কালের প্রবাহে ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের অভাবে নহর-এ-জুবাইদা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পর পানির চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন নতুন পর্যাপ্ত পানির উৎস তৈরি করা হয়। পরে নহর-এ-জুবাইদার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১২৯৫ হিজরিতে তৎকালীন শাসকরা নহর-এ-জুবাইদা ব্যবস্থাপনা ও মেরামত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৩৪৪ হিজরিতে উজানে নুমান উপত্যকায় বন্যায় খালটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে তিন মাসের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাদশাহ আবদুল আজিজ শাসনভার গ্রহণ করার পর নহর-এ-জুবাইদা সংস্কার করেন। কিন্তু ১৪০০ হিজরির প্রথম দিকে নানা কারণে নহর-এ-জুবাইদার পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং তা আর পুনঃসংস্কার করা হয়নি। এখনো হজ বা ওমরাহ পালনকারীরা মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের দিকে ঘুরলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত এই নহর-এ-জুবাইদা দেখতে পাবেন।
মানবদরদি রানি জুবাইদার স্মৃতি জাগরূক রাখতে সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে।
লেখক: আহমাদুল ইসলাম চৌধুরী