অনলাইন ডেস্কঃ
আমরা যারা ষাটের দশক থেকে রাজনীতি করি তারা কেউ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বা অন্য বিশেষণে ডাকার চেয়ে ‘মুজিব ভাই’ বলতে পছন্দ করি। ‘মুজিব ভাই’ ডাকটার মধ্যে অনেক মায়া-মমতা আছে। তিনি আমাকে অনেক আপন করে নিয়েছিলেন। প্রথমবার তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা এখনো প্রায়ই মনে পড়ে। ১৯৬৫ সাল। আমি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তখন ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ সভাপতি ছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনিও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিছুদিন আগে মোনেম খাঁর ট্রেন আটকে ৪০ মিনিট জিম্মি করে রেখেছিলাম। খবরটা ‘মুজিব ভাই’কে দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। হঠাৎ আমার ডাক পড়ল ঢাকায়। গেলাম। নজরুল ইসলাম ভাই আমাকে ধানমণ্ডি নিয়ে গেলেন। ‘মুজিব ভাই’কে সামনাসামনি দেখে তাঁর চোখের দিকে তাকাতেই পারলাম না, ভয়ে ও শ্রদ্ধায়। ‘মুজিব ভাই’ আমাকে দেখে একটু হাসির ছলেই বললেন, ‘এই আমার মার্শাল লিডার!’ বুঝতে পারলাম আমাকে হয়তো তিনি তাগড়া কোনো যুবক ভেবেছিলেন। আমি তখন খুব হ্যাংলা-পাতলা। সেই যে শুরু, এরপর যে কতবার ‘মুজিব ভাই’কে কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি হিসাব নেই। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। এখন অনেকেই বলেন, তাঁরা ‘মুজিব ভাই’য়ের খুব কাছের। একসঙ্গে খেয়েছেন, থেকেছেন। আমার সামনে এসে কি তাঁরা বলতে পারবেন তাঁরা সত্যিই ‘মুজিব ভাই’য়ের কাছের ছিলেন?
আমরা হাতে গোনা ৩০-৩৫ জন ছিলাম, যারা মুজিব ভাইয়ের ড্রয়িংরুম, বেডরুম, এমনকি গোপন বৈঠকেও যাতায়াতের সুযোগ পেতাম। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমার ওস্তাদ (আমির হোসেন আমু), নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদের, আব্দুর রাজ্জাক ভাইসহ আরো কয়েকজন।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আমি স্টেজের খুব কাছ থেকেই শুনেছিলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ছিলাম। সারা দিনই হৈচৈ আর দৌড়াদৌড়ি। একবার হলে যাচ্ছিলাম, আবার মাঠে যাচ্ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম কখন বঙ্গবন্ধু আসবেন। আমাদের হলে ১টার সময় দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়ে যেত। তাড়াতাড়ি এসে কিছু খেয়ে আবার মাঠের দিকে দৌড় দিলাম। হল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান খুব বেশি দূরে নয়। পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা। চারদিক থেকে লাখ লাখ মানুষ এসে ভিড় করেছে। ভাষণের সময় আমি স্টেজের কাছাকাছিই ছিলাম। আমি হলের নেতা, তবু সমাবেশের সামনের সারিতে থাকার সুযোগ হচ্ছিল না। মানুষের এত ভিড়, রীতিমতো দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পুরো জাতি সেদিন বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে আছে। এসে সেই কালজয়ী ভাষণ দিলেন, শুনলাম। আমাদের পরিকল্পনা তো আগেই ছিল, স্বাধীনতা। আমরা আলাপ-আলোচনা করছিলাম। তাঁর নির্দেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা তখন আমাদের কাছে যে কী ছিল, সেটা আসলে এখন বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমাদের মোটামুটি ধারণা ছিলই, তাঁর কাছ থেকে কী ঘোষণা আসবে। তিনি এসে নির্দিষ্ট করে যে নির্দেশনাগুলো দিলেন, সেটা পৃথিবীর আর কোনো নেতা কখনো দিতে পারেননি। মাও জেদং থেকে শুরু করে ফিদেল কাস্ত্রো—কেউই এতটা গুছিয়ে নির্দেশ দিতে পারেননি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল জাসদ, একদল বাংলার ছাত্রলীগ আর আমরা মূল ছাত্রলীগে রয়ে গেলাম। ১৯৭২ সালের কথা। আমার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল পুরো ক্যাবিনেট নিয়ে পাস করল। আর কোনো হল পুরো ক্যাবিনেট নিয়ে পাস করেনি। ‘মুজিব ভাই’ আমাকে ডাকলেন, পাশে বসালেন। সেদিন অনেক কথা বললেন। বিশ্বাস করুন, সেদিনও আমি ‘মুজিব ভাই’য়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারিনি। যতবার এই মানুষটার কাছে গেছি ততবার ভেবেছি, অনেক কথা বলব, দু-একটা নির্দেশনাও দেব। সত্যি বলতে, তাঁর সামনে গেলে সব ভুলে যেতাম। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুধু তাঁর কথা শুনতাম। যখন আমার থেকে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেন সেই ফাঁকে পুরো চেহারাটা একবার দেখে নিতাম। এখন তো অনেককেই বলতে শুনি, “আমি ‘মুজিব ভাই’য়ের স্নেহভাজন ছিলাম।” আসলে কি তাই? তিনি চার-পাঁচ হাজার নাম মনে রাখতে পারতেন। হয়তো একদিন নাম ধরে ডাক দিয়েছিলেন। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে স্নেহভাজন হয়েছেন। আমি তো নিজেকে নিয়েও সন্দিহান। আমি কি আসলেই তাঁর স্নেহভাজন হতে পেরেছিলাম! সারা দেশে তাঁর কোটি কোটি অনুসারী। সবাইকে তিনি সন্তান নয়তো ভাইয়ের মতো দেখেছেন। কিন্তু কতজন সত্যিকারের স্নেহভাজন হতে পেরেছেন! আমি গর্বিত। স্নেহভাজন হই আর না হই, প্রিয় এই নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে অসংখ্যবার খুব কাছ থেকে দেখার ভাগ্য হয়েছিল।
লেখক : চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ