মিয়ানমারে ইসলামের আগমন ঘটে আরব ও পারস্যের মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক অভিযান পরিচালনা করত। নৌপথে বাণিজ্যকারীদের জন্য মিয়ানমার ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। এ সময় মিয়ানমারে একাধিক সমুদ্রবন্দর গড়ে ওঠে।
যেমন সিতওয়ে, বাসিন, তানলিন, মুত্তামা ইত্যাদি।
মিয়ানমারে ইসলাম প্রসারে আরব বণিকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও দেশটিতে ইসলাম প্রচারে অন্যদেরও জোরালো অবদান রয়েছে। আরব বণিকরা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ভারতীয় উপকূল হয়ে চীনে পণ্য নিয়ে যেত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে তারা মিয়ানমারের মুত্তামা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছে যান।
সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে আরব বণিকরা আরাকান উপকূলে নোঙর করে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরব বাণিজ্য জাহাজ রামরি দ্বীপে এবং তানলিন সমুদ্রবন্দরে নিয়মিত নোঙর করতে শুরু করে।
নবম শতাব্দীতে মিয়ানমারের অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের যাতায়াত শুরু হয়। অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে জাহাজ ধ্বংস হওয়ার কারণে একদল আরব বণিক রামরি দ্বীপের কিয়কপুতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
তারা স্থানীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ধারণা করা হয়, তারাই ছিল মিয়ানমারে প্রথম আরব বংশোদ্ভূত এবং মুসলিম নাগরিক। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে আমির নসরুদ্দিনের নেতৃত্বে মোগল মুসলিমরা মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অভিযান চালায়। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট তিনজন মুসলিম উত্তর মিয়ানমারের বাসিন শাসন করেন।
তাঁরা মিয়ানমারে ইসলাম প্রচারে অনবদ্য অবদান রাখেন। তাঁদের সূত্রে সেখানে আরব, পারসিক ও ভারতীয় মুসলিম বণিকদেরও যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। বাসিন রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় রাজা বু মিন খং শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং মুসলমান বাসিনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ছেলে মিন বি কাইও জাওয়ার নেতৃত্বে বাসিনের পতন ঘটে। এ ছাড়া খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আরব বণিকরা মিয়ানমারের তানিনতারি অঞ্চলের মিত শহরে বসবাস শুরু করে। স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সদ্ভাব গড়ে ওঠে এবং তারা সামাজিক মর্যাদা লাভ করে। আরবরা এই শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিত।
আরবরা তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সততা, সাহসিকতা ইত্যাদির কারণে সহজেই মিয়ানমারে সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা লাভ করে। এমন কয়েকজন মুসলিম বিশিষ্টজন হলেন সেনাপতি খান সাহেব আবদুল করিম, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ওয়ালি খান ও আমির আউশাং, প্রধান বিচারপতি আবেদ শাহ হুসাইনি, বিচারক আবদুল করিম, আরাকানের শাসক হাজি আলী খান, সেনাপতি ইয়াকুব প্রমুখ।
স্থলপথে মিয়ানমারে ইসলাম প্রচারে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকাই মুখ্য। বিশেষত আরাকান অঞ্চলে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে চন্দ্র-সূর্য বংশের রাজা অযুথুর পুত্র নরমিখলা স্বীয় চাচাকে উৎখাত করে আরাকানের ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বার্মার রাজা মেং মো আই আরাকানে আক্রমণ করলে তিনি গৌড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ২৪ বছর বাংলার শাসকের আশ্রয়ে থাকেন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের সহযোগিতায় ক্ষমতা উদ্ধার করেন। তাঁর সহযোগিতার জন্য যাওয়া ৫০ হাজার মুসলিম সেনার অনেকে সেখানে থেকে যান। রাজা তাঁদের সম্মানে রাজধানী ম্রোহংয়ে একাধিক মসজিদ স্থাপন করেন। রাজ্য উদ্ধারের পর নরমিখলা মাত্র চার বছর রাজত্ব করেন। তখন আরাকানরাজ বাংলার সুলতানদের মতো মুদ্রার এক পীঠে ফারসি অক্ষরে কলেমা ও মুসলমানি নাম লেখার রীতি চালু করেন, যা পরবর্তী ২১৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় মুসলিমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদেও নিযুক্ত হন। যেমন প্রধানমন্ত্রী, সেনাপতি, মন্ত্রী, বিচারক প্রভৃতি। মুসলিলম নিজেদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে রাজ্যের উন্নয়নে অবদান রাখেন। নানা সংকটের মধ্যে ১৭৮২ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন টিকে ছিল। এরপর বর্মীরাজ ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ১৮২৩ সালে সে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়।