মেয়েটির নাম রায়া। পুরো নাম মামিজা রহমান। সে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। রায়া সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছিল, তার ইচ্ছা ও স্বপ্ন সে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে চায়।
করোনাভাইরাস মহামারিতে কর্মহীন ও অসহায় হয়ে পড়া মানুষের সহায়তায় ১০ হাজার টাকা দান করেন ভিক্ষুক নাজিমউদ্দিন। এই ১০ হাজার টাকা তিনি জমিয়েছিলেন নিজের ঘর মেরামতের জন্য। ঝিনাইগাতীর কাংসাই ইউনিয়নের গান্ধিগাঁও গ্রামের মানুষ। বয়স ৮০ বছর। এই ঘটনা জেনে নাজিমউদ্দিনের বাড়িতে পাকা ঘর তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
গফরগাঁওয়ের হাসমত আলীর কথা বলি। তিনি ছিলেন দরিদ্র ভ্যানচালক। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের অন্ধ ভক্ত। আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ের কথা শুনলেই সেখানে ছুটে যেতেন। ওদিকে সংসার চলছে কি চলছে না খবরও রাখতেন না। স্ত্রী রমিজা খাতুনও স্বামীর মতোই বঙ্গবন্ধুভক্ত। পঁচাত্তরের নৃশংস ঘটনার পর স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পাগলের মতো ঢাকায় ছুটে আসেন হাসমত আলী। গ্রামের বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে আগারগাঁও বস্তিতে কাটিয়ে দেন ২৫ বছর। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পর তাঁর যেকোনো মিটিং-মিছিলে চলে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে গিয়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের ভঙ্গিতে বসে থাকতেন। একটাই ছেলে তাঁর। ছেলের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন শেখ হাসিনাকে। প্রতিদিন নামাজ পড়ে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করতেন। বলতেন, ‘শেখ হাসিনা আমার মেয়ে। এই মেয়েটার জন্য কিছু একটা করা দরকার।’
২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গফরগাঁওয়ের রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া গ্রামে ২৪ হাজার টাকা দিয়ে ৭ শতাংশ জমি কেনেন। সেই জমি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নামে দলিল করে দেন। পরে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। স্ত্রী রমিজা খাতুন নিজের রক্ত বিক্রি করে স্বামীর যতটা পারেন চিকিৎসা করিয়েছেন। তাঁর ছেলে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন বলেছে ওই জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে। হাসমত আলী ও রমিজা খাতুন দুজনের একজনও কিছুতেই রাজি হননি।
স্বামীর মৃত্যুর পর রমিজা খাতুন ফুটপাতে থাকেন আর ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালান। এই ঘটনা ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় তুলে ধরেন সাংবাদিক হায়দার আলী। লেখার শিরোনাম ছিল ‘বিরল ভালোবাসা’। ঘটনাটি ২০১০ সালের।
‘বিরল ভালোবাসা’ লেখাটি চোখে পড়ল প্রধানমন্ত্রীর। পরদিন হায়দার আলী আর রমিজা খাতুনকে ডেকে পাঠালেন। সাংবাদিক হায়দার আলীকে দিলেন এক লাখ টাকা পুরস্কার আর রমিজা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভাসলেন। দুজনের কান্নায় এক আবেগঘন দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। তিনি রমিজা খাতুনের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন। তাঁর ছেলেকে চাকরি দিলেন আর তাঁর নামে কেনা সেই জমি হাসমত আলীর পরিবারকে হস্তান্তর করে সেখানে পাকা বাড়ি তুলে দিলেন। নিজে গিয়ে উদ্বোধন করে এলেন সেই বাড়ি।
এই হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। একেবারেই বাবার চরিত্র পাওয়া মেয়ে। সেই যে এক বৃদ্ধা মা বহু বহু বছর আগে নিজের জমানো চার আনা পয়সা গভীর ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেদিন যেমন আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঠিক তেমন করেই হাসমত আলীর অসামান্য ভালোবাসায় কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাঁর যাবতীয় মমত্ববোধ দেশের মানুষের জন্য। বাংলার মানুষের কল্যাণ কামনা এবং দেশের উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই তিনি ভাবেন না। বঙ্গবন্ধুও এভাবেই মানুষ ভালোবাসতেন। এভাবেই সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবার স্বপ্ন অনেকখানি পূরণ করেছেন কন্যা। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে স্বপ্নের সোনার বাংলা। দেশের যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যাচ্ছে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো স্বপ্ন সেতু নির্মাণের সাহস বঙ্গবন্ধুকন্যা ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তারপর একে একে মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা ও চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে, হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের থার্ড টার্মিনাল, একটার পর একটা ফ্লাইওভার, কালনা ব্রিজ, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। আর তৈরি করছেন শত শত গুচ্ছগ্রাম, লাখ লাখ মানুষকে দিচ্ছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। তার পরও কত ষড়যন্ত্র দেশ নিয়ে। কত রকমভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা উন্নয়নের গতি। কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। ১৮ বার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রতিবারই পরম করুণাময় তাঁকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। মানুষ যাঁকে ভালোবাসে, আল্লাহও তাঁকে ভালোবাসেন। দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পাচ্ছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। মানুষের দোয়া পাচ্ছেন। মানুষের ভালোবাসায় আর নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় বাংলাদেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দুর্বার গতিতে। দিনে দিনে তিনি হয়ে উঠেছেন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ নেতা, সারা বিশ্বের অগ্রগণ্য নেতা। তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা এখন বিশ্বজুড়ে। দেশের প্রতিটি দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা তিনি সামাল দিয়েছেন। তাঁর লড়াকু মনোভাব করোনাকালেও দেশের মানুষকে সাহস জুগিয়েছে, আশ্বস্ত করেছে। কূটনীতির ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের বড় বড় দেশ, বড় বড় নেতার কাছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কদর অনেক, রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মূল্য অনেক। তাঁর কথার গুরুত্ব অনেক। দেশের মানুষের কাছে শেখ হাসিনা এখন একমাত্র আস্থার প্রতীক। তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেই বসেন কোরআন তিলাওয়াতে। ফজরের নামাজ আদায় করে তিনি তাঁর কর্মময় দিন শুরু করেন। পুরো পরিবার হারানোর বেদনা বুকে চেপে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ গড়ার কাজে। মায়াবী দুই হাতে আগলে রেখেছেন এ দেশের ১৭ কোটি মানুষকে। পিতার মতোই তিনি জনমানুষের নেতা। দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর দেশের মানুষের কল্যাণ করা ছাড়া আর কিছুই তাঁর চাওয়ার নেই।
দেশের গৌরবে কী যে গৌরবান্বিত বোধ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা তার অনেক প্রমাণ আমরা দেখেছি আমাদের ক্রিকেট টিমের অতি উচ্চ সাফল্যের সময়। ক্রিকেটে যতবার বাংলাদেশ বিশ্বের বাঘা বাঘা দলকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে, ছিনিয়ে এনেছে দুর্দান্ত সব জয় তখন বঙ্গবন্ধুকন্যার মতো আনন্দিত হতে আমি কাউকে দেখিনি। আমাদের ক্রিকেট টিমকে উৎসাহিত করার জন্য তিনি স্টেডিয়ামে গিয়ে হাজির হয়েছেন। খেলোয়াড়দের কৃতিত্বে শিশুর মতো উচ্ছল ও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।
শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকন্যার সীমাহীন আগ্রহ। বিপদে পড়া বা অসুস্থ শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের পাশে সব সময় তাঁর হাতটি প্রসারিত থাকে। কত অভিনেতা, গায়ক-গায়িকা, পরিচালককে তিনি নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি কখনোই দল বিচার করেননি। শিল্পীর যথার্থ মর্যাদাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। লাখ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এত এত রাষ্ট্রীয় কাজের মধ্যেও শিল্প-সাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন। সাহিত্য পড়েন নিয়মিত।
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে প্রতিবাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। কৃষিবিদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠান। আমাকে ডাকা হয়েছে কথা বলার জন্য। প্রধান অতিথি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাইকে কথা শেষ করে নিজের চেয়ারের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। মঞ্চের মাঝখানে বসে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। আমাকে ডেকে বললেন, “তোমার ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ উপন্যাসটি আমি পড়েছি। উপন্যাসে তুমি ভাগীরথীর কথা লিখেছ। ভাগীরথীকে কোন রাজাকার পাকিস্তানিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, তা জানো?”
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘না আপা।’
তিনি বললেন, সেই রাজাকারটির নাম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। তিনি আমার মতো সামান্য একজন লেখকের একটি উপন্যাস পড়েছেন এবং সেই উপন্যাসের না লেখা একটি তথ্য বলে দিয়েছেন। কতটা মেধাবী মানুষ হলে এটা সম্ভব!
বঙ্গবন্ধুকন্যা লেখেন। তাঁর বেশ কিছু বই আছে। যেমন—‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন?’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন’, ‘কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’, ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘সাদা কালো, সবুজ মাঠ পেরিয়ে’। আর আছে ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’। যে বই পড়ে চোখের জলে ভাসে মানুষ। এ ছাড়া অসামান্য তিনটি ভূমিকা তিনি লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর তিনটি বইয়ের। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভূমিকা লিখেছিলেন এক-এগারোর সময় অন্তরিন থাকা অবস্থায়। ভাবতে অবাক লাগে, ও রকম মানসিক চাপে থাকা অবস্থায় একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে বাবার বইয়ের এ রকম একটি ভূমিকা লিখতে পারেন! তাঁর মনের জোর কোন পর্যায়ের! এই বইয়ের ভূমিকা পড়েই তো চোখের জলে ভাসবে মানুষ। খাতাগুলো উদ্ধারের পর একেকটি পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে যেভাবে চোখের জলে ভেসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, ভূমিকা পড়ে পাঠকও আক্রান্ত হন সেই আবেগে।
আমি একবার অত্যন্ত বিনয়ীভাবে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপা, আপনার বইগুলো আমি পড়েছি। টুকরোটাকরাভাবে জীবনের অনেক কথা আপনি লিখেছেন। অনেক স্মৃতির কথা লিখেছেন। আপনি কি কোনো পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লিখবেন?’ তিনি খুব সরল গলায় বললেন, ‘আত্মজীবনী লেখার মতো কী এমন বড় কাজ আমি করেছি, বলো?’ তাঁর ওটুকু কথায় আমি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ’র অনুরণন শুনতে পেলাম। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ।’ সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”
আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারে বাবা ও মেয়ের যেন একই রকমের বিনয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্মদিনের এই শুভলগ্নে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি তাঁর নিজের ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সবটুকু বাস্তবায়ন যেন দেখে যেতে পারেন। পরম করুণাময় আমাদের এই প্রিয় নেতার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ মঙ্গলময় করুন।