অনলাইন ডেস্ক:
বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে আবার এসেছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মানুষের চলাচল বেড়ে গেছে সংগত কারণেই। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বিপুলসংখ্যক মানুষ সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। এ অবস্থায় বেড়ে গেছে করোনা সংক্রমণ আবার ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা। বিশেষ করে ‘ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট’ দেশে ছড়িয়ে পড়লে কী পরিস্থিতি হতে পারে, তা নিয়ে উদ্বিগ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবারও করোনা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কভিড-১৯ বিশ্বমহামারির ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ধীরে ধীরে নিচে নামছে। অনেকের মনে শঙ্কা, আবার ‘তৃতীয় ঢেউ’ আসবে না তো? বিশেষ করে যখন নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটছে। তবে ভারতে যদি এই মুহূর্তে কভিড-১৯ বিশ্বমহামারির তাণ্ডব না-ও থাকত, তবু আমাদের দেশে ‘তৃতীয় ঢেউ’ ওঠার শঙ্কা আছে। কারণ সারা বিশ্ব থেকে কভিড-১৯ মহামারি দূর না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই যেকোনো দেশে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যারা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পেরেছে, তারা তত সহজে ‘নতুন ঢেউ’ সামাল দিয়েছে।”
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সারা দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। মহামারিতে মৃত্যু আর আতঙ্কের মধ্যে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। এই স্থবিরতার মধ্যে উদযাপিত হয়েছিল ঈদুল ফিতর। করোনার প্রথম ঢেউয়ে জুলাই মাসে দেশে এক দিনে মৃত্যু সর্বোচ্চ ৬৪ জনে পৌঁছেছিল। দেশের অর্থনীতি পড়ে বিপর্যয়ের মধ্যে। এরপর সংক্রমণ কমে এলে সাধারণ ছুটি বাতিল করে কলকারখানা সচল করার মাধ্যমে দেশে অর্থনীতির চাকা সচল করার চেষ্টা করা হয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে টিকাদানের উদ্যোগও নেওয়া হয়। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দেশে যখন টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন হয়, তখন বিশ্বের অনেক উন্নত দেশও টিকাদান শুরু করতে পারেনি। মার্চ মাসে এসে দেশে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এপ্রিল মাসে এসে সরকার কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে দিনে মৃত্যু পৌঁছায় ১১২ জনে। সরকার অফিস-আদালত, শপিং মল, গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে। শর্ত সাপেক্ষে চালু রাখা হয় কলকারখানা।
কিন্তু জীবন বাঁচাতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়ে জীবিকা। এ অবস্থায় বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর দূরপাল্লার গণপরিবহন ছাড়া সব কিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন সংকটাপন্ন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ার কারণে অনেকেই কাজ হারিয়েছে। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে নিম্ন আয়ের ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষ। আয়-উপার্জন সীমিত হয়ে গেছে। কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তারা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জরিপে এই তথ্য উঠে আসে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে বেরিয়ে এসেছে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।
দেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। ২৬ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার পর আর চালু করা যায়নি। দেশের প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটো পাস দেওয়া হলেও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা ঝুলে আছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ারই সুযোগ পাচ্ছে না। এদিকে করোনা প্রতিরোধের টিকা নিয়ে শুরু হয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতি। দেশের প্রায় ১৪ লাখ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ টিকা যথাসময়ে পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এ অবস্থায় যারা টিকার আওতায় আসেনি, তাদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারটি আরো বেশি অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
এ অবস্থায় দ্বিতীয়বারের মতো এসেছে ঈদুল ফিতর। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ঈদ উৎসবকে সংকটাপন্ন মানুষকে সহায়তার ক্ষেত্রে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসলামের সহমর্মিতার বাণীকে অনুসরণ করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
শোলাকিয়া ঈদগাহর ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ মনে করেন, পবিত্র ঈদ উপলক্ষে মুসলমানদের সামনে একটি বড় সুযোগ এসেছে অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। মুসলমানদের ওপর নির্দেশনা রয়েছে, ঈদের নামাজের আগেই যেন ফিতরা পরিশোধ করা হয়। সঠিকভাবে জাকাতের টাকা পরিশোধ করার মাধ্যমেও গরিব মানুষের উপকারে আসা যায়।
করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের ঈদ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় ঈদ উপলক্ষে কোলাকুলি ও হাত মেলানো না করতে বলা হয়েছে। সবাইকেই মাস্ক পরতে হবে এবং নামাজে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতেও হবে। শিশু, বয়োবৃদ্ধ, যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থ ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সব স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার তাগিদ দিয়ে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে যে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে তার সঙ্গে শরিয়তের বিধানের কোনো বিরোধ নেই। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে করোনাভাইরাস আরো ছড়িয়ে দেওয়া বন্ধে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘোরাঘুরি না করে নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই উদযাপন করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জীবন সবার আগে। বেঁচে থাকলে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা হবে।’
ঈদ উৎসব উপভোগ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা না করারও তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, বাইরে কোনো কিছু স্পর্শ করার পরে সাবান দিয়ে দুই হাত ধুয়ে ফেলা, অন্য মানুষের কাছ থেকে কমপক্ষে দুই হাত দূরে থাকা, বদ্ধ ঘরে ভিড় সৃষ্টি না করা ইত্যাদি নিয়ম অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।