অনলাইন ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ কমিয়ে আনতে ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেন, এই মহামারি স্বাস্থ্যসংকট ছাড়িয়ে আর্থ-সামাজিকব্যবস্থা ও জীবন-জীবিকার ওপর ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অজানা শত্রুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ভুটান ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশ দারুণ সহযোগিতা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ মহামারি আমাদের নতুন বাস্তবতা শিখিয়েছে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার পাশাপাশি এসব বাস্তবতাও আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কভিড-১৯ মহামারির নতুন প্রকোপ মোকাবেলা করছে।’
পিটিএ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো দেশের সঙ্গে এই প্রথম অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করল এবং ভুটানই প্রথম দেশ যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অগ্রাধিকারমূলক এই বাণিজ্য চুক্তি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী ৫০ বছর আমাদের অঞ্চলের বাসিন্দাদের টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির সাক্ষী হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ মহামারি থেকে চমৎকারভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা আরো জোরদার করার ইচ্ছা পোষণ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময় আমার মনের মধ্যে আছে।’
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশিদের হৃদয়ে ভুটানের জন্য একটি বিশেষ অবস্থান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী একটি স্থান রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভুটানের তৃতীয় রাজা এবং সেখানকার জনগণের অবিচ্ছিন্ন সমর্থনের পাশাপাশি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তাদের দেশের স্বীকৃতি আজও আমাদের আবেগতাড়িত করে।’
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য, পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি, আইসিটি, শিক্ষা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ আজ আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো অনেক বিস্তৃত।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এখন সময় এসেছে পারস্পরিক সুবিধা এবং নাগরিকদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য দুই দেশই তাদের দৃঢ় সম্পর্ককে আরো অর্থবহ করে তুলবে এবং এরই ধারাবাহিকতায় উভয় দেশ আজ বাংলাদেশ-ভুটান পিটিএতে স্বাক্ষর করেছে। ‘এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভিন্ন ধরনের পণ্য উভয় দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ পেতে পরে। চুক্তিতে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে পণ্যের অতিরিক্ত তালিকা অন্তর্ভুক্ত করারও বিধান রয়েছে,’ বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের আরো বেশি মানুষ ভুটানের তাজা আপেল ও কমলা হাতের নাগালে পাবে এবং ভুটানের ফ্যাশন সচেতন মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভালোমানের আরো বিভিন্ন ধরনের পোশাক বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুকের দূরদর্শী নির্দেশনা ভুটানের রূপান্তর বাংলাদেশ অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছে। ভুটান আজ একটি গণতান্ত্রিক, আধুনিক এবং প্রগতিশীল দেশ। ‘গড় জাতীয় উৎপাদনের পরিবর্তে তার (ভুটানের চতুর্থ রাজা) গড় জাতীয় সুখের’ ধারণাটি বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর ছেলে এবং উত্তরসূরি, পঞ্চম রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভুটানের উন্নয়নে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁর পিতার নীতিগুলো অব্যাহত রেখেছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্যও একই রকম এবং তা হলো—গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা এবং দেশের জনগণকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের সুখী নাগরিকে পরিণত করা, যে স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন। ‘আজ, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক শক্তিশালী এবং আমাদের অর্থনীতিও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আইনের শাসন এবং মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করি,’ বলেন শেখ হাসিনা।
এই প্রসঙ্গে তিনি ‘ভিশন ২০২১’ এবং ‘ভিশন ২০৪১’ এর কথা উল্লেখ করেন; সোনার বাংলাদেশ গড়তে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি সুরক্ষা, শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজকল্যাণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশের পাশাপাশি উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ভুটানের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী লোকনাথ শর্মা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে। স্বীকৃতিদানের পর থেকে সুদীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এদিন ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করা হলো।
বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বাণিজ্য ছিল ১২.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন বাংলাদেশ ০.৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি ও একই সময় আমদানি করে ১২.১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য।
দুই দেশের বাণিজ্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৭.৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। এ সময় বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৭.৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য, একই সময় ভুটান থেকে আমদানি হয় ৪৯.৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য।
সূত্র : বাসস।