মধুখালী (ফরিদপুর) প্রতিনিধিঃ
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের ডুমাইন গ্রামের গড়াই খেয়া ঘাটে প্রতিদিনই বসছে জুয়ার আসর। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় অবাধে চলছে মাদকের কেনাবেচা। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের প্রকাশ্য বিচরণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে গ্রামবাসী। কেউ কিছু বললে তাদের ওপর নেমে আসে খড়গ।
স্থানীয় বিভিন্ন সুত্রে প্রাপ্ত ডুমাইন গ্রামে দিনরাত চলে মাদক কারবারিদের ব্যবসা। ডুমাইন মাদকসেবীদের নিরাপদ স্থান হওয়ায় নির্বিঘ্নে চলে তাদের ফেনসিডিল, ইয়াবা, টাফেনটা ট্যাবলেট, গাঁজা ও হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক সেবনের কাজ। তবে মাদকসেবীদের আনাগোনা বেশী লক্ষ্য করা যায় বিকেল থেতে গভীর রাত পর্যন্ত। রাত যত বাড়ে মাদক সেবীদের জন্য ডুমাইন গ্রাম পরিণত হয় অভয়ারণ্য।
ডুুমাইন খেয়াঘাটে বসে জুয়ার আসর । চলে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত । প্রচলতি আছে এই আসরে প্রতিদিন ৫০/৬০ লক্ষ টাকার জুয়া চলে। সন্ধ্যা নামলেই চলে নারীর দেহের রঙ্গমঞ্চও। এসময় জুয়ার আসর বা জুয়ার টাকা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ আতিয়ার রহমান নিয়ন্ত্রণ করেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার অনেকে জানিয়েছেন, এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী হলো ডুমাইন ইউনিয়নের মো: বদিয়ার রহমান টগর মোল্লার ছেলে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আলী মোল্ল্যা, মৃত তিলাম সেখের ছেলে মো. জাফর শেখ, মো. ফজলু মোল্ল্যার ছেলে মো. সাইফুল মোল্ল্যা, মৃত আঃ মজিদ মোল্লার ছেলে আমিরুল মোল্লা, মৃত আঃ ওহাব সেকের ছেলে আকিদুল সেক এবং মৃত আলাল মোল্যার ছেলে সোহাগ রানা সহ প্রমুখ।
ডুমাইনের মাদক নিয়ন্ত্রণ করেন এই সোহাগ রানা। এদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে বকুল মোল্ল্যার ছেলে মো. শিমুল মোল্ল্যা। সাইফুল এবং শিমুল দুজনেই পেশায় চোর ছিল। এদের বিরুদ্ধে এর পূর্বে এলাকায় চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। সাইফুল মোল্ল্যার বিরুদ্ধে এলাকায় ডাকাতির মামলাও রয়েছে। তার বাবা ফজলু মোল্ল্যারও এলাকায় ছিঁচকে চোর হিসেবে বেশ নামডাক রয়েছে।
জাফর খানের শাশুড়ি বিভিন্ন জেলা থেকে মাদক বহন করে ডুমাইনে এনে জামাইকে দিয়ে বিক্রি করে আসছেন। আলী মোল্লা মাদকের ব্যবসা করে ৩ তলা ভবনের কাজ শুরু করেছেন। তার আপন চাচাতো ভাই সাইফুল মোল্লাও বিএনপির সক্রিয় কর্মী। তারা দীর্ঘ দিন ধরে নিজ বাড়িসহ ডুমাইন গ্রামের মোল্ল্যা পাড়া ও গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রয় করে থাকেন। যা এলাকায় মাদকের হাট নামে পরিচিতি রয়েছে। আর ওইসব জায়গা থেকে আশেপাশের গ্রাম ও দূর দূরান্তের আসা বিভিন্ন মাদকসেবী ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হিরোইন সেবন ও ক্রয় করে থাকে। বর্তমানে ডুমাইনকে মধুখালীর মাদকের রাজধানী বলা হয়।
মাদক বিক্রেতা বা ব্যবসায়ীরা মাঝে মধ্যে কৌশল পরিবর্তন করে মাদক বিক্রয়ের স্থান পরিবর্তন করে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। এছাড়াও করোনার কারণে ওই এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেখানকার কোমলমতি শিক্ষর্থীদের হাতেও ইয়াবা তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে করা হচ্ছে মাদক ব্যবসা। আর এসব মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থকেন গ্রামের প্রভাবশালী কিছু লোক। তাদের ছত্রছায়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা অবাধে মাদক ব্যবসা চালালে এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পান না।
মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে দু-একজনকে আটক করলেও গডফাদাররা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী একজন সচেতন ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে বলেও অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোন জোরালো ব্যবন্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাই বন্ধও হচ্ছে না তাদের মাদক ব্যবসা।’
ডুমাইন গ্রামের এসব মাদকের ব্যাবসা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভুক্তভোগী গ্রামবাসী।
এখানে মাদক বেচাকেনার পাশাপাশি চলে টপের খেলা। এক সময় ডুমাইন গ্রাম ছিল উপজেলার মধ্যে শিক্ষিত ও ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি সবকিছুতে এ গ্রামের অনেক সুনাম ছিল। বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, আর্মি অফিসার এবং ১৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছে এই গ্রামে। যেটা সারা দেশে বিরল। কিন্তু গত কয়েক বছরে অত্র গ্রামে টপ আর মাদক ছড়িয়ে পরার পর তরুণ সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। গ্রামের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
মাদক ও জুয়ার ভয়াবহতার বিষয়ে নাম না প্রকাশের সর্তে কয়েকজন বলেন, ‘এখানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ভদ্রলোকের বসবাসের অনুপোযোগী।’
জুয়া এবং মাদকের বিষয়ে ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ খুরশিদ আলম মাসুমের কাছে জানতে চাইলে মোবাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি মাদক-জুয়া মুক্ত করতে। কিছুটা সফল হলেও পুরাপুরি সফল হতে পারিনি। করোনার কারণে পুলিশের নজর সেদিকে থাকায় আবার সরগরমে চলছে জুয়া খেলা আর মাদকের ব্যবসা। আমি চাই জুয়া কিংবা মাদকে আমার সন্তান, ভাইও যদি জড়িত থাকে তাকে আইনের আওতায় আনা হোক। আমি চাই আমার ইউনিয়ন মাদক-জুয়ামুক্ত হোক।’
মধুখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আমিনুল ইসলামের কাছে মোবাইলফোনে জানতে চাইলে তিনি জানান, উপজেলা ও পৌর সদরে যারা মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন পরিচয়কেই তাকে রক্ষা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘নেশাখোর ও কারবারীদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি। তাদের জেলে বসে প্রহর গুনতে হচ্ছে।’
ওসি বলেন, ‘উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নটা হচ্ছে ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং মাগুরা জেলা তিনটি সীমান্ত এলাকা এবং থানা সদর থেকে বেশ দূরে ভৌগলিক অবস্থা অপরাধীদের অনুকূলে। যে কারণে মাদক ব্যবসায়ী ও জুয়ারীরা সুযোগটা নিয়ে থাকে। তবে যাদেরই নাম আসুক তাদের আইনের আওতায় আসতে হবেই। সমগ্র উপজেলাটাই মাদক জুয়া মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে সাথে নিয়ে বিট পুলিশিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সমাজ থেকে চিরতরে অপরাধ নির্মূল করবো।’
এ ব্যাপারে মধুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মির্জা মনিরুজ্জামান বাচ্চুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অঙ্গীকার করেছেন দেশ থেকে জাঙ্গীবাদ মাদক ও জুয়া নির্মূলের। আমরা তাঁর অনুসারী হিসেবে উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদক ও জুয়ারীদের একটা তালিকা করে পুলিশ প্রশাসনকে দিয়েছি। আমার প্রাণ প্রিয় নেত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে বলি মধুখালী উপজেলাকেও মাদক জুয়া সন্ত্রাসমুক্ত করবো। কোন মাদক ব্যবসায়ী জুয়ারী সন্ত্রাসীকে ধর্ষণকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’