Saturday , 23 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
মগবাজারের বিস্ফোরণ যে কারণে
--সংগৃহীত ছবি

মগবাজারের বিস্ফোরণ যে কারণে

অনলাইন ডেস্ক:

রাজধানীর মাগবাজারে ‘রাখি নীড়’ নামের তিনতলা ভবনটির নিচতলায় রেস্টুরেন্ট শর্মা হাউসের ভেতর থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণস্থলে জমাটবদ্ধ গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা মিথেন গ্যাস ও সরকারিভাবে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসে থাকা হাইড্রোকার্বনের আলামত পেয়েছেন। ঘটনার সময় বৈদ্যুতিক কোনো সূত্র থেকে শক ওয়েভ হয়েছে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ গ্যাসের সংস্পর্শে আসায় এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত রবিবার রাতে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট সংলগ্ন এলাকা প্রকম্পিত করে বিভীষিকা ছড়ানো বিকট শব্দের এই বিস্ফোরণে সাতজনের প্রাণহানি নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। বিস্ফোরণে ভবনটিতে থাকা লোকজন, পথচারী ও বাসের যাত্রী মিলে শতাধিক মানুষ আহত ও দগ্ধ হয়। বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে ভবনটি দেবে যাওয়ার পাশাপাশি রাস্তায় তিনটি বাসও দুমড়েমুচড়ে যায়। আশপাশের অন্তত অর্ধশত ভবনের কাচ ভেঙে পড়ে। গোটা এলাকার বিদ্যুৎ চলে যায়। সড়কের বাতিগুলোও নিভে যায়। অনেকের বাসাবাড়ির সংযোগে বিঘ্ন দেখা দেয়।

রাখি নীড়ের সামনের রাস্তায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ড্রেনেজ সংস্কারকাজ চলছে। এতে গ্যাসের সংযোগে ফুটো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শর্মা হাউসের রান্নাঘরে গ্যাসের সিলিন্ডারও ছিল। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ভবনটিতে গ্যাসের সংযোগ নেই বলে দাবি করলেও প্রতিবেশীরা আবাসিক সংযোগ থাকার তথ্য দিয়েছে। তাত্ক্ষণিকভাবে ভবনের জেনারেটর বিস্ফোরণের সন্দেহ করা হলেও নিচতলা থেকে প্রায় অক্ষত জেনোরেটর বের করেছেন উদ্ধারকারীরা। তারা বলছেন, গত বছর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পশ্চিম তল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের মতোই আলামত মিলেছে মগবাজারে। শনির আখড়ায়ও ২০১৯ সালে একই ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে।

ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সোমবার ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করেছে। আলামত সংগ্রহ করেছে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত কমিটি এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ও ক্রাইম সিন ইউনিট। রবিবার রাতেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে। পুুলিশের বিভিন্ন বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশ এ ঘটনায় একটি জিডি করেছে।

গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘বড় ধরনের একটা শকড ওয়েভ তৈরি হয়েছিল, এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। এখনো ভবনের ভেতরে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ, নাশকতা বা বিস্ফোরণ হলে চতুর্মুখী বিস্ফোরণ হতো। আমরা চারদিকে কাচের টুকরা দেখছি। ভেতরে গ্যাসের অস্তিত্ব ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, ‘এ বছর অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে, শনির আখড়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি করেছে। তবে আমাদের ফায়ার এক্সপ্লোরেশন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস মিলে পুলিশের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি করে তদন্ত করব। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে।’

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) ও তদন্ত কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এর আগে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল সেটিও এখানকার সমপর্যায়ের উপাদান থেকে ঘটেছিল। নারায়ণগঞ্জ ও মগবাজারের ঘটনার আলামতের মিল রয়েছে। আমরা মগবাজারের ঘটনাটিও তেমন অনুমান করছি।’ তিনি বলেন, ‘ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী। মেরামত করেও ব্যবহার করা যাবে না। বর্তমানে এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটি ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।’

তদন্ত কমিটির সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) ছালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ধারণা করছি, জমে থাকা গ্যাসে ভবনটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছিল। কোনো স্পার্ক হয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আলামতগুলো ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখা হবে।

ঘটনাস্থলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের এনার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস বিভাগের উপসচিব ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শুধু গ্যাস লিকেজ কিংবা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো সাধারণ বিস্ফোরণে এত এক্সপ্লোশন বা ক্ষতি হয় না। ঘটনাস্থলে হাইড্রোকার্বনের অস্তিত্ব পেয়েছি, যা সরকারিভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ইলেকট্রিক্যাল এক্সপ্লোরেশন হতে পারে, গ্যাসলাইনে লিকেজ বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ’

গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রাখি নীড়ের পশ্চিম পাশে মগবাজার প্লাজা ও পূর্ব পাশে কল্লোল ট্রেড সেন্টারসহ কয়েকটি ভবনের দেয়ালের কাচসহ জিনিসপত্র ভেঙে পড়েছে। রাখি নীড়ের নিচতলায় বাঁ পাশে গ্র্যান্ড কনফেকশনারি, মাঝে শর্মা হাউস ও ডান পাশে বেঙ্গল মিটের দোকান ছিল। সেগুলোর অস্তিত্ব নেই।

মগবাজার প্লাজার মালিক হারুন উর রশিদ বলেন, এক সপ্তাহ ধরে রাত ১২টা থেকে ড্রেনেজ লাইনের কাজ করছেন কর্মীরা। যাদের ভবনে গাসলাইন আছে তা দেখিয়ে দিতেও তাঁরা বলেন না। কোনো ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থাও নেই।

স্থানীয়রা জানায়, রাখি নীড়ের মালিক মশিউর রহমান খোকন। ১৯৭২ সালে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটিতে শর্মা হাউসের সিলিন্ডার ছাড়াও গ্যাস সংযোগ ছিল। কারণ মালিক ভবনটিতে আবাসিক সংযোগ ব্যবহার করতেন। চেষ্টা করেও মশিউর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ডিএসসিসির ড্রেনেজের কাজের সঙ্গে বিস্ফোরণের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে কি না, জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের কাজ চলছে দূরে। তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে যে সেই কাজের কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে কি না। আমাদের প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনের ঝুঁকি দেখেছে।’

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বলেন, ‘শর্মা হাউস ও তার দুই পাশের ভবনে তিতাসের কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। ঘটনাস্থলে এলপিজির সিলিন্ডার দেখতে পেয়েছেন তিতাসের তদন্ত কমিটির সদস্যরা।’ গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্যও দেন।

পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামানকে প্রধান করে সাত সদস্যের আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে আলামতগুলো বিশ্লেষণ শুরু করেছে বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঘটনাস্থলে তদন্তকারীরা গ্যাসের আলামত পেয়েছে। সেখানে অন্য কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি এখনো পায়নি তদন্তদল।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। প্রাথমিক তদন্ত চলছে। আমাদেরও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির নির্দেশনা ও প্রাথমিক তদন্ত শেষে মামলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।’

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ও সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা সেখানে ৮-৯ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছি। এমন ঘটনা অব্যবস্থাপনা বা অনিয়মের কারণে ঘটছে।’ সঠিক নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা না থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে বলে সতর্ক করেন তিনি।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply