অনলাইন ডেস্ক:
এক সময়কার বিরান দ্বীপ ভাসানচর এখন সুপরিকল্পিত জনপদ। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে, অনেক শ্রমে-ঘামে সেখানে নির্মিত হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষের বাসস্থান। ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, একসময় ভাসানচরে শুধু কিছু বন আর মহিষ ছিল। পরিবেশের দিক বিবেচনায় রেখে যেখানে অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে, সেখানে শুধু গাছ কাটা হয়েছে। ২০১৮ সালে ১২ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক দিন-রাত কাজ করেছেন এখানে। অগ্রাধিকারমূলক এ প্রকল্প দ্রুত শেষ করার তাড়া ছিল।
জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে ভাসানচরে অবকাঠামো নির্মাণে। শুরুতে পরিস্থিতি ও প্রকৃতি অতটা অনুকূল ছিল না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে, তাদের তুলনামূলক ভালো পরিবেশ, জীবন-জীবিকার সুযোগ করে দিতে দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ভাসানচর এখন রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ‘৪২০টি মাহিন্দ্রা ট্রাক্টর এখানে কাজ করেছে। নৌবাহিনীর সদস্যদের এখানে রীতিমতো ট্রাফিকিং করতে হয়েছে পুলিশের মতো। নদী থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে মালামাল নিয়ে নির্মাণ কাজ করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। রাস্তাঘাট উঁচু ছিল না। ভেতরে পানি জমা হতো। এ অবস্থা এখন আর নেই। উত্তর-দক্ষিণে সাত কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে পাঁচ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।’
জানা গেছে, ভাসানচরে নির্মাণকাজের মূল ঠিকাদাররা পৌঁছান ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির পর। বড় বড় অনেক কম্পানি ভাসানচরে নির্মাণকাজের দায়িত্ব পেতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় যাঁদের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ৩০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার বাজেট হিসাব করে কাজ দেওয়া হয়েছে। একেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি করে মোট ১২০টি ক্লাস্টারের কাজ একই সময়ে করেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যথাসময়ে কাজ শেষ করার তাগিদ থেকেই বড় একটি কম্পানিকে নির্মাণের দায়িত্ব না দিয়ে ৩০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নৌবাহিনীর ২০০ সদস্য, কনসালট্যান্ট ও ইঞ্জিনিয়ারদের তদারকির মাধ্যমে কাজ শেষ করা হয়েছে।
প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে আছে মাল্টিপারপাস সেন্টার। সেগুলো শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, নামাজ আদায়সহ নানা ধরনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের র্যামে ঝড়ের সময় ২০০ থেকে ২৫০ মহিষ রাখার জায়গা করা হয়েছে।
মাটি থেকে ক্লাস্টার হাউসের শেল্টারের প্রথম তলার উচ্চতা ১৪ ফুট। প্রতি শেল্টারে এক হাজার জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। অন্যদিকে সন্দ্বীপ ও হাতিয়ায় চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে শেল্টার হাউস। ভাসানচরে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে মোট ৪২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ছয় থেকে সাত কিলোমিটার আরসিসি সড়ক।
পশ্চিমা কিছু বেসরকারি সংস্থা ঢালাওভাবে সমালোচনা করে আসছে যে ভাসানচর একটি নিচু দ্বীপ। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তাদের সে সমালোচনা হালে টেকেনি। ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পরামর্শ নিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওলিংফোর্ডের।
জানা গেছে, ভাসানচর দ্বীপকে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় বাঁধের উচ্চতা ঠিক করা হয়েছে ১৭৬ বছরের সাইক্লোন ডাটা স্টাডি করে। একই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বঙ্গোপসাগরের ১০ হাজার বছরের সাইক্লোনের সিনথেটিক ডাটা।
ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ‘এ পর্যন্ত কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র ভাসানচর অতিক্রম করেনি। সমীক্ষা অনুযায়ী, ভাসানচরের সবচেয়ে কাছ দিয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করেছিল ১৯৯৭ সালে। সেটিও ছিল ভাসানচর থেকে ৩৬ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৬৬.৭ কিলোমিটার) দূরে।’
তিনি বলেন, ‘ভাসানচরের বাঁধের ৯ ফুটের কাজ হয়েছে। আরো ১৯ ফুটের কাজ চলছে।’
জানা গেছে, এই ৯ ফুট বাঁধ দিয়েই সাম্প্রতিক সময়ের আম্ফান, বুলবুল ও ফণীর মতো সামুদ্রিক ঝড় খুব ভালোভাবে সামাল দেওয়া গেছে। এ তিনটি সাইক্লোনে বাঁধের বাইরের দিকে তিন থেকে চার ফুট পানি ছিল মাত্র। এমনকি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময় অনেক জেলে ভাসানচরে আশ্রয় নিয়েছিল।
২০১৮ সালের মে মাসে ভাসানচরে বাঁধের মূল কাজ শেষ হয়। এ জন্য ২০০ থেকে ২৫০টি বুলডোজার একসঙ্গে কাজ করেছে। গত বছর এবং চলতি বছরও বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভাসানচরের ভেতরে কোথাও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। ১৮টি স্লুইস গেটের মাধ্যমে ভাসানচর থেকে পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে।
ভাসানচরে সমুদ্রের ঢেউ সরাসরি আসে এমন আড়াই কিলোমিটার এলাকাও সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বাঁধ থেকে আরো প্রায় আধা কিলোমিটার সামনে সাগরের সেই ঢেউকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এতে আর তীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।