সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেয়ার পর তাকে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ প্রদান করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। ভারত যদি সত্যি শেখ হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্রদান করে থাকে তাহলে কি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দু’দিন আগে অবশ্য বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেওয়া হলে তা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই।
জানা যায়, পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুই শতাধিক মামলাও হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই। চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য ফেরত চাওয়া হয় তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত।
কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ভারতের যে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে সে অনুযায়ী কেউ যদি কোনো অন্যায় করে আইনিভাবে দোষী সাব্যস্ত হন, ওইরকম ব্যক্তিবর্গ যদি বাংলাদেশ বা ভারতে আশ্রয় নেন তাহলে উভয় দেশ চুক্তি অনুযায়ী তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল যা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০ এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইশোরও বেশি মামলা হয়েছে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে। চুক্তি অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে পারে ভারত।
এই প্রশ্নে দু’টি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী যদি আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও তাকে ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দরকার হতে পারে।’ অর্থাৎ এই কূটনীতিক বিশ্লেষকের মতে, আইন ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয় হলেই কেবল শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে পারে ভারত। তবে, এখনই সেই সুযোগ দেখছেন না বাংলাদেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ কবে ফেরত চাইতে পারে?
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলাও হচ্ছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সাথে ভারত ও থাইল্যান্ড এই দুটি দেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত এনে বিচার করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ কেন দুই মাসেও কোনো মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলো না কিংবা তাকে ফেরত আনার উদ্যোগ নিলো না সেই প্রশ্নও রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কোর্ট বসলে প্রথম দিনই আমরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ চাইবো। কোর্ট যদি তাকে গ্রেপ্তারের ইনিশিয়াল অর্ডার দেন তখন তাকে ফেরত আনতে আমরা কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইবো।
তবে যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ও, তারপরও বাংলাদেশ চাইলেই যে তাকে ফেরত পাবে এমন কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আইনগতভাবে ভারতের কাছে বাংলাদেশ অনুরোধ করতেই পারে। কিন্তু এখানে ভারতেরও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অনেক বিষয় আছে।’
ট্রাভেল ডকুমেন্ট কি কোনো বাধা হতে পারে?
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গত অগাস্টেই তিনিসহ তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী-উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য সবার পাসপোর্ট বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলছেন, ‘শেখ হাসিনার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। তাকে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কোনো পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়নি। সেক্ষেত্রে তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট ভারত সরকার দিতেই পারে।’
কূটনীতিকরা বলছেন, এই ট্রাভেল ডকুমেন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশই দিয়ে থাকে। যাদের পাসপোর্ট থাকে না তাদের নির্দিষ্ট একটা দেশে যেতে বা সেখান থেকে ফেরত আসার জন্য এটা দেয়া হয়ে থাকে। যদি শেখ হাসিনাকে সত্যি ভারত থেকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয় তাহলে তিনি যদি অন্য কোনো দেশে যান, সেখান থেকে তাকে ফেরত আনা যাবে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে দেশের রাজনীতিতে।