Wednesday , 23 October 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা বিস্তারে সুফিদের ভূমিকা
--ফাইল ছবি

ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা বিস্তারে সুফিদের ভূমিকা

অনলাইন ডেস্কঃ

জ্ঞানই ছিল ভারতবর্ষের সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক রাহ্বারদের সবচেয়ে ধ্যান-জ্ঞান ও কামনা-বাসনা। তাঁরা জ্ঞানের প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং জ্ঞানের সেবা করেছেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন সাহিত্যের বোধ ও উচ্চতর জ্ঞানগত দক্ষতার অধিকারী। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ইলম তথা জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়।

একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিদ্যালয় ছিল তাঁদের খানকাগুলো। যেখানে হাজারো মানুষের আশ্রয় মিলত।

খানকা ও বিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় তাঁরা শাসকদের সহযোগিতার প্রত্যাখ্যান করতেন এবং জনগণকে তাতে সম্পৃক্ত করতেন। যেন শাসকের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করা যায় এবং জনসাধারণের দ্বিনি চেতনা ও দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। শায়খ সাইয়েদ মুহাম্মদ সাঈদ আম্বালাভি (রহ.) ছিলেন খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের মনীষী। তাঁর জীবনী রচয়িতারা লেখেন, ‘তাঁর খানকায় প্রথম যুগেই যারা ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকত, তাদের সংখ্যা পাঁচ শর চেয়ে কম ছিল না এবং সমপরিমাণ লোক সব সময় যাওয়া-আসার মধ্যে থাকত। একবার সম্রাট ফররুখ শিয়ারের আমির রওশন দৌলা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে খানকা নির্মাণের জন্য ৬০ হাজার রুপি উপহার দেন।

শায়খ রওশন দৌলাকে বলেন, অর্থগুলো এক জায়গায় রেখে তিনি যেন বিশ্রামে যান। ফলে রওশন দৌলা ফিরে যান এবং শায়খ অসহায় মানুষদের খবর দেন। তিনি আম্বালাহ, থানেশ্বর, সেরহিন্দ ও পানিপথের এতিম, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের ভেতর সমুদয় অর্থ বিতরণ করে দেন। তাঁর হাতে একটি অর্থও রাখলেন না। এরপর রওশন দৌলা এলে শায়খ তাঁকে বলেন, ‘অসহায় মানুষ ও যারা নিজেদের আল্লাহর রাস্তায় নিয়োজিত রেখেছে, তাদের সেবা করার সওয়াব ভবন নির্মাণের চেয়ে বেশি।’ একবার শায়খ সাইয়েদ মুহাম্মদ সাঈদ (রহ.)-এর কাছে সম্রাট মুহাম্মদ ফররুখ শিয়ার, আমির রওশন আলী ও আমির আবদুল্লাহ খানের চিঠি পৌঁছেয় তিন লাখ রুপিসহ। তিনি পুরো টাকা প্রতিবেশী গ্রাম ও এলাকাগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দেন।

সুফি সাধকদের খানকা ও বিদ্যালয়গুলো ছিল বৈষম্যহীন এবং সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানি (রহ.) যথার্থ বলেছেন, ‘এসব খানকাই ছিল ধনী-গরিবের মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধন। সুফি সাধক ও মাশায়েখদের দরবার ছিল এমন ভাণ্ডার, যেখানে রাজা-বাদশাহরাও খাজনা জমা দিতেন। যুবরাজ খিজির খান শায়খ নিজামুদ্দিনের দরবারে উপস্থিত হয়ে উপকৃত হতেন। এমনিভাবে সম্রাট আলাউদ্দিন, যিনি সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে কর আদায় করতেন, তিনি একটি দরবারে কর জমা দিতে বাধ্য ছিলেন।

ধনী ও দরিদ্রের এই ঐক্য ও মেলবন্ধন সুফি সাধক ও পীর-মাশায়েখ, যাঁদের দরবারে ধনী ও দরিদ্র সবাই সমানভাবে উপস্থিত হতো এবং উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেত। তাঁদের মাধ্যমে অসহায় মানুষের অভাব পূরণ হতো। বাস্তবতা হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন যুগ যায়নি এবং ভারতের এমন কোনো অঞ্চল ছিল না যেখানে পীর-মাশায়েখ ও সুফিরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদিস বাস্তবায়ন করেননি। তাহলো ‘জাকাত তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করো’। সুতরাং তাঁরা ছিলেন দরিদ্র, অসহায় ও নিঃস্ব মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে সুফিবাদের ইতিহাস সাধনা, অল্পে তুষ্টি, আত্মমর্যাদা, সম্মান, উচ্চাঙ্ক্ষা ও পরোপকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে ভরপুর। এ দেশের কোনো সুফিধারাই এসব গুণ ও তার দৃষ্টান্ত থেকে শূন্য নয়। তাঁরা নিজেদের জীবনাচারের মাধ্যমেও ইসলামের শিক্ষাকে তুলে ধরেছেন। যেমনটি মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে বলা হয়।

নকশাবন্দিয়া মুজাদ্দেদিয়া তরিকার বিশিষ্ট বুজুর্গ ছিলেন শায়খ শামসুদ্দিন হাবিবুল্লাহ (রহ.)। তিনি মির্জা জানে জানাঁ দেহলভি নামে পরিচিত ছিলেন। একবার ভারত সম্রাট তাঁকে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে সুবিশাল রাজত্ব দান করেছেন। আমি চাই, আপনি তা থেকে কিছু অংশ গ্রহণ করুন। তিনি বলেন, আল্লাহ দুনিয়াকে নিচু ও হীন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, বলুন! দুনিয়ার ভোগবিলাস অতি সামান্য। আপনারা পৃথিবীর মহাদেশগুলোর একটি মহাদেশের ছোট্ট রাজত্ব লাভ করেছেন। সুতরাং আমি এই ছোট অংশে অনধিকার চর্চা করতে চাই না।

একবার ‘টুংকু’-এর শাসক নবাব মীর খান শায়খ গোলাম আলী দেহলভি (রহ.)-এর খানকার বার্ষিক সভার ব্যয়ভার গ্রহণের আবেদন করলেন। শায়খ তার উত্তরে একটি কবিতা লিখলেন। যার অর্থ নিম্নরূপ—‘আমরা দারিদ্র্য ও অল্পে তুষ্টিকে অবশ্যই ছোট করে দেখি না এবং তার সম্মানের ওপর আঁচড় কাটতে চাই না। তুমি মীর খানকে বোলো দাও আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত।’

তাঁদের এই নির্মোহ জীবনধারাও ছিল সাধারণ আলেম ও ধর্মীয় নেতৃত্বের জন্য উত্তম শিক্ষা।

তামিরে হায়াত থেকে

আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply