২৫ মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয় গণহত্যা। তাদের এ সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। পূর্বপরিকল্পিত এই সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল রাত সাড়ে ১১টার পর। গোপনে ঢাকা ত্যাগ করা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিমান নিরাপদে করাচি ও কলম্বোর মাঝামাঝি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে।
ঢাকায় সামরিক অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের বিশেষ টার্গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর সংলগ্ন এলাকায় নামানো হয় ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচের একটি করে তিন কম্পানি (চার শতাধিক) সেনা, যাদের দায়িত্ব ছিল জহুরুল হক হল (তখনকার ইকবাল হল), জগন্নাথ হলসহ অন্যান্য টার্গেট সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। সেখানে অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন ৩২ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তাজ।
সকালবেলা হলের তালা ভেঙে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই হত্যা করে দারোয়ানদের। চতুর্দিকে ভারী বুটের শব্দ, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ এবং অবিশ্রান্ত গুলির আওয়াজ। এরপর হানাদার সেনারা জগন্নাথ হলের উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ছাত্রদের খোঁজ করে। তারা কক্ষের অভ্যন্তরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, শৌচাগার ও স্নানাগার ইত্যাদি স্থানে তল্লাশি চালায়। তারা যাকে যেখানে পায় সেখানেই গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করে। একই সঙ্গে চলে বাঙালি, বঙ্গবন্ধু ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সম্পর্কে অশ্লীল গালাগাল।
হলের বিভিন্ন তলায় পড়ে থাকে ছাত্রদের মরদেহ। জল্লাদ পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন ছাদে উঠে যায়। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির ছাদে উত্তোলন করা ছিল কালো পতাকা ও বাংলাদেশের পতাকাখচিত প্রস্তাবিত পতাকা। সেনারা ঘৃণাভরে পতাকা দুটি টুকরা টুকরা করে ফেলে দেয়। উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, সত্য দাস, রবীন, সুরেশ দাসসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হায়েনার দল। এ পরিস্থিতিতে উপেন্দ্রচন্দ্র রায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করা হয়। মৃত অবস্থায় তাঁর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অশ্লীল গালাগাল করে অন্যদের ছাদের ওপর লাইন করে দাঁড় করায় সেনারা। তারপর গুলি চালায়। শহীদ ছাত্রদের মরদেহ ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয় তারা।
২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও বাইরে থেকে আসা অতিথি মিলে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করে গণকবরে মাটিচাপা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। ওই ৭০ জনের মধ্যে ছিলেন, তিনজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র ও চারজন হলের কর্মচারী। শহীদ তিনজন শিক্ষক হলেন—ড. এ এন এম মুনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (জি সি দেব, দর্শন) ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিজ্ঞান)। ড. মুনীরুজ্জামানের পুত্র ও কয়েকজন আত্মীয়কেও হত্যা করা হয়।
২৭ মার্চ নিজ বাসভবনের বাইরে গুলিবিদ্ধ হন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি)। তাঁকে ধরাধরি করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন এ নিবন্ধের লেখক তাঁকে হাসপাতালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখেছিলেন। ৩০ মার্চ ড. গুহঠাকুরতা হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদন দের (মধুদা) বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকেও হত্যা করে। প্রাণ দেন মধুদার স্ত্রী, পুত্র আর পুত্রবধূও। শিববাড়ীর পাঁচজন সাধুকেও বর্বর পাকিস্তানি সেনারা অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে জগন্নাথ হলের মাঠে।
লেখক : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি