ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অন্তত অর্ধশতাধিক সরকারি-বেসরকারি অফিস ও স্থাপনা এবং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িসহ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
রেলস্টেশন থেকে থানা ভবন, এসপি অফিস, পুলিশ ফাঁড়ি, পৌরসভা, পৌর মিলনায়তন, ক্রীড়া সংস্থা, মন্দির, ভূমি অফিস, গণগ্রন্থাগার, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সিভিল সার্জন ও মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সার্কিট হাউজ, পানি সম্পদ কার্যালয়, উন্নয়ন মেলা, বেসরকারি ব্যাংক- হেফাজতের আগুন থেকে বাদ যায়নি কিছুই। ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল হামলাকারিদের প্রধান টার্গেট। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির প্রতি বিশেষ ক্ষোভ ফুটে উঠে হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে। প্রতিটি প্রতিকৃতিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। ২৬ থেকে ২৮, এই তিন দিন যেন একাত্তরের যুদ্ধের খণ্ডচিত্র দেখেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। ২৮ মার্চ পুরো শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এত এত ধ্বংসলীলা কারা চালালো, কেন চালালো? কারা গান পাউডার, পেট্রোল সরবরাহ করেছে? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জেলাবাসীর মুখে মুখে।
হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে মিলে-মিশে ছদ্মবেশে তাণ্ডবের নেপথ্যে কারা কাজ করেছে এসবের অনুসন্ধ্যান করে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সেদিনের তাণ্ডবের জন্য হেফাজতে ইসলাম-ই প্রধানত দায়ী। প্রথম দিন ২৬ মার্চ তাদের নেতাকর্মীরাই তাণ্ডব চালিয়েছে। রেলস্টেশনসহ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা মৎস্য ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। পরের দু’দিন হেফাজতের মিলে-মিশে একাকার হয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একটি পক্ষও হামলা-ভাংচুরে অংশ নেয়।
অবশ্য হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা বলছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর উস্কানিতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ ঘটনা ঘটে। আগের দিন জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বের করা মিছিল থেকে মাদ্রাসায় হামলা করা হয় সাংসদের নেতৃত্বেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, হরতালের দিন হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন জামায়াত-শিবিরসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একটি গ্রুপও হামলা, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছিল।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভিডিও ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে ইতোমধ্যে তাণ্ডবের মদদ-দাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ২৬ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোদিবিরোধী কর্মসূচিতে হামলার অভিযোগে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সিরাজিয়া মাদরাসার শিক্ষক ও হেফাজতে ইসলামের জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক বোরহান উদ্দিন আল-মতিনের নেতৃত্বে প্রথম মিছিল বের হয়। একই সময় স্থানীয় বড় মাদরাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার শিক্ষক ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও জেলা সভাপতি আল্লামা শায়েখ সাজেদুর রহমান ও জেলা সেক্রেটারি মুফতি মোবারক উল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল বের হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, এই দুই মিছিল থেকেই প্রথম দফায় হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার অনুসন্ধানকারী বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বিতীয় দিনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে নন্দনপুর এলাকায় হেফাজতের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রায় একই সময় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করেও সংঘর্ষ শুরু হয়। আর তৃতীয় দিনের হরতালকে কেন্দ্র করে হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত-শিবির, বিএনপির নেতাকর্মীরা মিলেমিশে তাণ্ডব চালায়।
জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার আশপাশের এলাকা বিএনপি অধ্যুষিত। এ কারণে আওয়ামী লীগের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা ও আশপাশের মসজিদ থেকে মাইকিংও করা হয়। মিছিল ঠেকাতে একযোগে লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে পড়তে বলা হয় সবাইকে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় দিন অর্থাৎ হরতালের দিন হামলা ছিল পরিকল্পিত। সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাংচুর করা হয় জেলা পরিষদ ভবন, পৌরসভা ভবন, পৌর মিলনায়তন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, পুলিশ লাইনস, সদর মডেল থানা, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা, অরুয়াইল পুলিশ ফাঁড়ি, শহরের কেন্দ্রীয় মন্দির শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী বাড়ি, দক্ষিণ কালী বাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তার নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার চত্বর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন। হামলাকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরাও ভাংচুর করে নষ্ট করে দেয়।
জেলা পুলিশের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা জানান, সাধারণ হেফাজতকর্মীদের মাথায় সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নেওয়ার বিষয়টি আসার কথা নয়। এটি জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত কর্মীদের কাজ হতে পারে।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, কয়েকটি মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, স্থানীয় বিএনপি নেতা মাহফুজুর রহমান পুষ্প মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলী এলাকার রাজঘর গ্রামে বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে মিছিল বের করে।
তান্ডবের পরের দিন প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় সাংসদ মোকতাদির চৌধুরী অভিযোগ করেন, হেফাজত, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি বিদ্রোহী অংশও মাঠে ছিল। আওয়ামী লীগের এ অংশ পৌর নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হক ভূঁইয়ার অনুসারী।
তবে মাহমুদুল হক ভূঁইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন। তিনি বলেন, হেফাজতের তান্ডব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। হেফাজতের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাই ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-বিজড়িত স্থাপনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও ম্যুরালের প্রতি প্রচন্ড-ক্ষোভ ছিল তান্ডবকারীদের। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল দেখামাত্রই তারা খুঁচিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। জেলার জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন পৌর মঞ্চে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরাল, ব্যাংক এশিয়ার সামনে ও বিপরীতে দুটি, কাউখালীতে একটি ও পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটের সামনে থাকা একটি ম্যুরালকে খুঁচিয়ে বিকৃত করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, হামলাকারীরা এই দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠী। তাদের কর্মকান্ড দেখলেই তা বোঝা যায়। তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, ছবি, ব্যানার সবকিছুতেই আগুন দিয়েছে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন আবরনির পরিচালক হাবিবুর রহমান পারভেজ বলেন, ‘এর আগেও গত ১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সকল প্রতিকৃতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল দুষ্কৃতিকারীরা। এবারও তান্ডবকারীদের বেশি ক্ষোভ দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির ওপর। যেখানেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল দেখেছে, সেখানেই হামলা চালিয়েছে। রেলস্টেশনে বঙ্গবন্ধুর ছবির একটি প্রদর্শনী চলছিল, সেখানেও আগুন দিয়েছে তারা।
এসব বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের জেলা শাখার পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে হেফাজতের নেতারা দাবি করেন, তারাও তাণ্ডবের নিরপেক্ষ তদন্ত চান। হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অনেক ভিডিও ফুটেজ তাদের সংগ্রহে রয়েছে। সেসব দেখে দোষীদের শনাক্ত করারও দাবি জানানো হয়।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন দিনের নারকীয় তান্ডবকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন অনেকে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রথম দিনের পরও পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল না জেলা শহরে। এমন কি হরতালের দিন সকাল দশটা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত শহরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্যকেও দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় লোকজন বলছেন, সহিংসতার আগাম গোয়েন্দা-তথ্যও সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা পুলিশ। এমনকি খোদ সদর থানা থেকে মাইকে ‘হামলাকারীদের কিছু করা হবে না’ শর্তে থানায় হামলা না চালানোর অনুরোধ করা হয়।
জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় এই পর্যন্ত মোট ৪৯ টি মামলা দায়ের হয়েছে। ৩০০ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাতনামা ৪৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় মোট ১২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৬ জন নিহত হয়েছে। জেলার পৃথক স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সাথে সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্ত্মত তিন শতাধিক লোক আহত হয়েছে। এখন পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের সহিংসতায় ৪৯ টি মামলা হয়েছে। ৩০০ জনের নামসহ ৪৫ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ১২০ জন আটক করা হয়েছে।