অনলাইন ডেস্ক:
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? এর কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্পর্কে? ঘাতকচক্র ও হঠাৎ ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমেদ।
তিনি তাঁর ‘ক্রিটিক্যাল টাইমস : মেমোয়ারস অব আ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোমেট’ গ্রন্থে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কূটনৈতিক অঙ্গনে এর প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকার স্মৃতিচারণা করেছেন।
ক্রিটিক্যাল টাইমসের ত্রয়োদশ অধ্যায় ‘ট্র্যাজেডি অ্যান্ড টারমোয়েল’-এ তিনি লিখেছেন, দৃশ্যত ভারত ও রাশিয়ার গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি টের পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন তাঁর নিজ দেশে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র জানত না এটি বিশ্বাস করা কঠিন। তা ছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সিআইএ উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকারীরা ঢাকায় ভারতসহ বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। এর মধ্যে ভারতীয় হাইকমিশনের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল কয়েক দিন।
ফখরুদ্দীন আহমেদের লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক সেনা কর্মকর্তা ও তৎকালীন নেতৃত্ব সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁরা মিথ্যা গল্পও সাজিয়েছিলেন। যেমন : খন্দকার মোশতাকের ভাষ্য ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। বিদ্রোহী সেনারা চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে জিম্মি করে পদত্যাগ করাতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বাধার মুখে সেনারা গুলি চালান! আর এতেই দুর্ঘটনাবশত তাঁরা নিহত হন।
এই গল্প বিশ্বাস করেননি পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমেদ। বরং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে ছবি তুলেছিলেন যে আলোকচিত্রী তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা শুনে পররাষ্ট্রসচিবের মনে হয়েছে, হত্যার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল।
ফখরুদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেল হত্যার পর ওই ঘাতকচক্র দেশ ছেড়ে গিয়েছিল থাইল্যান্ডে। এরপর সেখানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও গণ-অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে থাইল্যান্ড সরকারও তাদের আশ্রয়ের মেয়াদ বাড়াতে অপারগতা জানায়। ঘাতক সেনা কর্মকর্তারা তখন দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কারও কারও আগ্রহও ছিল। কিন্তু জেনারেল জিয়া তাঁদের দেশে ফেরার বিরোধী ছিলেন। দেশে নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় তৎকালীন নেতৃত্ব ঘাতকদের দেশে ফেরানোয় বাদ সাধেন। ঘাতকদের পাসপোর্ট জমা রাখতে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিল।
তৎকালীন নেতৃত্বের নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাজ্য বা হংকংয়ে ঘাতকদের আশ্রয়ের সুযোগ খুঁজেছিল। কিন্তু ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে স্পষ্ট জানান, ঘাতকদের যুক্তরাজ্য বা হংকংয়ে নামতে দেওয়া হবে না। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে লিবিয়া তাঁদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়।
পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমেদকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টায় সার্কিট হাউস থেকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তুলে নেওয়া হয় রেডিও স্টেশনে। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন খন্দকার মোশতাক। পররাষ্ট্রসচিবকে তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ভারত কি বাংলাদেশ আক্রমণ করবে?
ফখরুদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, তাঁর জোরালো ধারণা ছিল এ ধরনের কিছু ঘটবে না। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, রেডিওতে যেন বিদেশি মিশনগুলোর নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পুলিশকেও যেন এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৬ আগস্ট মোশতাক বঙ্গভবনে ফখরুদ্দীন আহমেদকে তলব করেন। ফখরুদ্দীন আহমেদকে মোশতাকের প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিবকে কীভাবে কবর দেওয়া উচিত। ফখরুদ্দীন আহমেদ জবাব দেন, যথাযথ সম্মানের সঙ্গে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ভালো বার্তা যাবে। এরপর মোশতাকের প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে দেশের ভেতর প্রতিক্রিয়া কেমন? ফখরুদ্দীন আহমেদ তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে দেখিয়ে বলেন, তিনি ভালো বলতে পারবেন। মোশতাক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, পররাষ্ট্রসচিব কূটনৈতিক উত্তর দিয়েছেন।
দুইদিন পর তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমেদের কাছে সরকারের মুখ্য সচিব মাহবুব আলম চাষীর প্রশ্ন ছিল, এই অভ্যুত্থানের কী প্রভাব পড়বে বৈদেশিক সম্পর্কে? ফখরুদ্দীন আহমেদ অকপটে বলেন, ১৫ আগস্টের আগে বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাবনা ছিল ইতিবাচক। সেটি বদলে যাবে।
সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন