জেমস উইলসন নামের এক বেলজিয়াম নাগরিক, ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর বেটার গভর্নেন্স নামক সাময়িকীতে বাংলাদেশে সংঘটিত ১৫ এবং ২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের ওপর যা লিখেছেন, তার কিয়দাংশ বাংলায় অনুবাদ করে ছাপানো প্রয়োজন মনে করছি। জেমস উইলসন বেলজিয়ামের একজন নামজাদা সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
তিনি লিখেছেন, “৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পেয়েছিলেন তাদের ইতিহাসের কৃষ্ণতম সকাল। সেই সকালে সে দেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধু (বাংলার বন্ধু) বলে উল্লেখ করে থাকেন, তাঁকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ চরম পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়।
সাংবাদিক জেমস উইলসন আরো লিখেছেন, “৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত নারীর কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, জাতির জনক হত্যার মাধ্যমে তাতে যবনিকাপাত ঘটিয়েছিল বেআইনিভাবে ক্ষমতার জবরদখলদাররা।
জাতির জনক ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ধর্মান্ধদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়ে ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। যেই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগসাজশের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের ওপর চালিয়ে যাওয়া গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন, জিয়া তার বাংলাদেশে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। গোলাম আযম ছাড়াও জিয়া আরও বহু যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন। এসব যুদ্ধাপরাধীর অধিকাংশই ছিল জামায়াতে ইসলাম দলের নেতা-কর্মী, যেটি চরমপন্থি ধর্মান্ধ দল। জিয়াউর রহমান তার দলে এবং সরকারে অগণিত স্বাধীনতাবিরোধীকে শীর্ষ স্থান দিয়েছিলেন। জিয়া সেই শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালে যার অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের শীর্ষে। এভাবে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিধানসমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিলেন। আলি আহসান মুজাহিদসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাকে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়ে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া একই ধারা অনুসরণ করেছেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নামক আর এক জঘন্য যুদ্ধাপরাধীকেও মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগ করে জিয়ার স্ত্রী, খালেদা জিয়া স্বামীর উত্তম অনুসারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে যৌথভাবে চালিয়ে যাওয়া বছর অন্ধকারময় শাসনকালে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সেই সরকারের সময় বিচারহীনতার সংস্কৃতির এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত সরকারের শীর্ষ নেতাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য একটি ঘৃণ্য গ্রেনেড আক্রমণ চালানো হয়েছিল। শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার শুরু করা ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই সম্ভব হয়েছিল। সে বছরই নভেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সদস্যদের সমন্বয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ/আইন রহিত করেছিলেন। সেই রহিতকরণ আইনের ওপর ভোট গ্রহণকালে বিএনপি-জামায়াতের সংসদ সদস্যরা সংসদে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। সেই হত্যার বিচার বহু আগে বিএনপি শাসন আমলেই হতে পারত, কিন্তু সেটি তারা করেননি বিধায় দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাওয়ার পর বিচার শুরু হয়।
বিচারটি হয়েছিল দেশের প্রচলিত আইনে, প্রচলিত আদালতে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত, অ্যাপিলেট ডিভিশন, ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ১২ জন খুনির বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদন্ডাদেশ নিশ্চিত করে রায় প্রদান করেন। ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের দন্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল। সাতজন পলাতকের মধ্যে একজন জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। আর একজন পলাতক ২০২০ সালে ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে দন্ডাদেশ সে বছর কার্যকর করা হয়। পলাতক পাঁচজনের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ সরকারের পৌনঃপুনিক অনুরোধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা এদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার প্রকাশ্যেই বলেছেন এসব দন্ডপ্রাপ্ত, সস্বীকৃত খুনিদের যে দেশ আশ্রয় দেয়, তারা কি মানবাধিকারের কথা বলতে পারে? এখন সময় হয়েছে দেশ দুটিতে পলাতক দন্ডপ্রাপ্তদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা যে তারা সত্যি সত্যি মানবাধিকার এবং আইনের শাসনে বিশ্বাস করে, নয়তো জগৎবাসী ভাববে এগুলো তাদের ফাঁকা বুলি বৈ কিছু না।”
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি