Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
বীরযোদ্ধা থেকে যেভাবে ভিলেনে পরিণত হলেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা
--ফাইল ছবি

বীরযোদ্ধা থেকে যেভাবে ভিলেনে পরিণত হলেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা

অনলাইন ডেস্ক:

শ্রীলঙ্কা এখন এক সন্ধিক্ষণে- এক তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট দেশটির দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবনে উলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পর রাজাপক্ষেদের একসময় বীর হিসেবে বন্দনা করেছে অনেকে। কিন্তু এখন তারা শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সমালোচিত রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। কীভাবে এরকম ঘটলো এবং এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে?

এপ্রিলের শুরু থেকে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তার ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে দায়ী করা হচ্ছিল। কিন্তু এ সপ্তাহে পরিস্থিতি একেবারে নাটকীয় মোড় নিল।

প্রথমত, সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপক্ষের সমর্থকরা হামলা চালানোর পর দেশজুড়ে তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল। এর পর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে হলো। এক ডজনের বেশি রাজনীতিকের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হলো- এর মধ্যে কিছু বাড়ি ছিল রাজাপক্ষেদের।

বিক্ষুব্ধ জনতা ৭৬-বছর বয়সী রাজাপক্ষের সরকারি বাসভবনও ঘেরাও করেছিল, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনতে হয়। এখন তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বে একটি নৌ-ঘাঁটিতে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। শ্রীলঙ্কার আদালত তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যিনি দুই দুইবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টও ছিলেন, তার জন্য এটি এক বিরাট অবমাননা।

কিন্তু পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও মানুষের ক্ষোভ কমেনি, তার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা অটল।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট এখনো পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করেছেন, তবে তাকে বাধ্য হয়ে কিছু ছাড় দেয়ার প্রস্তাব দিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে তার কিছু নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়েছেন। তিনি ঝানু রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে।

কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো সুতায় ঝুলছে। অনেকে মনে করেন, তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর শ্রীলঙ্কা যখন এ যাবৎকালের সবচেয়ে শোচনীয় অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন দেশটিতে এরকম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিস্থিতিকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। জিনিসপত্রের দাম যেরকম বেড়ে গেছে, খাদ্য এবং জ্বালানির যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণ এখন ক্রোধে ফুঁসছে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ছিল যে পরিবারের বিরাট আধিপত্য, তাদের জন্য এটি এক বিরাট পতন। একসময় শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিলেন বীর নায়ক। কারণ তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর যেসব বড় বড় বিজয় শোভাযাত্রা এবং জনসভা হয়েছিল, সেগুলোতে তাকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হতো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলেন, স্বাধীনতা উত্তর শ্রীলঙ্কায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহলি বৌদ্ধ নেতা। অনেকে তো তাকে এমনকি সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করতো।

পেরেরা ২০১৭ সালে ‘রাজাপক্ষে: দ্য সিনহালা সেলফি’ বলে যে বই লেখেন, তাতে এই দ্বীপ রাষ্ট্রের রাজনীতিতে রাজাপক্ষে পরিবারের ভূমিকা এবং কীভাবে মাহিন্দা রাজাপক্ষে নিজেকে ক্ষমতার জন্য তৈরি করেছেন, তা তুলে ধরেছেন।

তার বাবা ছিলেন একজন সংসদ সদস্য এবং মাহিন্দা সংসদে একজন বিরোধী নেতা থেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন।

এক বছর পর তিনি যখন প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন, তখন তার ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন। গোটাভায়া শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। তার জন্য এটা ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক উত্থান।

তিনি দেশে ফিরে তার ভাইয়ের সরকারে যোগ দিলেন এবং বিরাট খ্যাতি অর্জন করলেন তার নিষ্ঠুরতার জন্য। এরপর রাজাপক্ষে পরিবারের আরো অনেক ভাই এবং আত্মীয়-স্বজন সরকারে যোগ দিলেন। তবে রাজাপক্ষে সাম্রাজ্যের মূল ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা, বলা যেতে পারে তিনিই এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

এ পর্যন্ত দুই ভাইকে সবসময় ঐক্যবদ্ধই দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন গোতাবায়া তার ভাই মাহিন্দাকে বিক্ষোভাকারীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বলেন সব কিছুর দায় নিয়ে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষের জন্য এটি ছিল এক বিরাট অপমান, কারণ তিনিই তার ছোটভাই গোতাবায়াকে ক্ষমতায় এনেছেন। রাজনীতি থেকে তাকে এভাবে বিদায় নিতে হবে সেটা তিনি কখনো কল্পনাও করেন নি।

“আসলে তরুণদের বিরাট প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনে তিনি ইতস্তত করেছিলেন, এরপর তার তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন,” বলছেন পেরেরা।

তবে মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল দুই ভাইয়ের মধ্যে এরকম কোন দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করেছেন।

মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের আগে এ সপ্তাহেই তিনি বলেছিলেন, তবে প্রেসিডেন্ট এবং (সাবেক) প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নিশ্চয়ই নীতিগত প্রশ্নে পার্থক্য ছিল।

নামাল রাজাপক্ষে বলেন, তার বাবা মাহিন্দা রাজাপক্ষে সবসময় কৃষক এবং জনগণের পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে গোতাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতাসীন দল এসএলপিপির মূল সমর্থক এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে দোদুল্যমান ভোট টানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে যে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাতে হয়তো বিক্ষোভকারীরা খুশি, তবে গোতাবায়া রাজাপক্ষেকেও ক্ষমতা থেকে তাড়াতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সমর্থকরা এরকম পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছেন।

“বাইরে বিশৃঙ্খলা চলছে বলেই, হতে পারে এর যৌক্তিক কারণ আছে, আমরা সবাই তা মানছি- তার মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে,” বলেন সাবেক গণমাধ্যম মন্ত্রী নালাকা গোডাহেওয়া।

যে ভোটারদের সমর্থনে ২০১৯ সালে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সমর্থন হারানোর পর প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এখন কি করবেন, তা স্পষ্ট নয়।

রাজাপক্ষে নাকি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী নন, তবে দেশকে বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে তিনি বের করে আনতে চান।

শ্রীলংকায় এখন রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভ, তাতে এই কাজ যে তিনি করতে পারবেন, সেই সুযোগ কম। তিনি যেরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন , তাতে এরকম আশঙ্কা আছে, তিনি হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন।

বহু বছর ধরে শ্রীলংকার সিংহলিদের মধ্যে রাজাপক্ষেদের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল, যদিও তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগ ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের অনেকেই তখন এসব নিয়ে কথা বলেনি।

কিন্তু এখন পুরো দেশ যখন সঙ্কটে পড়েছে, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ সব জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সিংহলি বিক্ষোভকারীরাও এখন সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন।

সূত্র: বিবিসি।

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply