প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্যঃসমাপ্ত জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার এক নতুন দিগন্তের সূচনা। প্রধানমন্ত্রীর এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিল মূলত বিশ্বব্যাংককে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অর্ধশতাব্দীর যে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে তাকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বব্যাংক নিউ ইয়র্কের প্রধান কার্যালয়ে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের এই বিশেষ আয়োজনে উপস্থিত থেকে কথা বলেছেন মন খুলে। বিশ্বব্যাংকও প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানিত করেছে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং প্রশংসাও করেছে উচ্চ:স্বরেই।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার ৫০ বছরের মাইলফলককে যেভাবে স্মরণ করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেভাবে সম্মানিত করেছে তেমনটা এর আগে কখনো হয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। বিশ্বব্যাংক পৃথিবীর বহু দেশের উন্নয়নে সহযোগী অংশীদার এবং অনেক দেশের সঙ্গে তাদের ৫০ বছরেরও অধিক সময়ের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও বিশ্বব্যাংক এভাবে ঘটা করে সেই সম্পর্ক স্মরণ করেছে—এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এমন বিশেষ সম্মান পেলেন। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা।
বিশ্বব্যাংকের আয়োজন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের দৃশ্যমান প্রাপ্তিগুলো হচ্ছে—এক. অর্থনৈতিক উন্নতির স্বীকৃতি, দুই. সহযোগিতার নতুন দিগন্তের সূচনা এবং তিন. রাজনৈতিক সমর্থন। বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে তা আজ সারা বিশ্বেই আলোচিত ও স্বীকৃত। বিশ্বব্যাংক ঘটা করে বাংলাদেশের এই উন্নতিকে স্মরণ করায় বাংলাদেশ যে বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়ে গেল। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নে আরো অধিক পরিসরে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করেছে এবং এরই মধ্যে তার প্রতিফলনও দেখা গেছে সেই অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশের সঙ্গে ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।
রাজনীতির যে সফলতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন তা অবশ্য খালি চোখে দেখা বা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না। আমরা যাঁরা অর্থনীতি ও ফিন্যান্স নিয়ে কাজ করি তাঁদের কিছু রাজনীতির খবরও রাখতে হয়। সেসব খবর বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগদান করে বিশেষ রাজনৈতিক সফলতা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বিশ্বব্যাংক একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যাংকের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে সতর্কতার সঙ্গেআর্থিক সংস্থা হলেও এর খুঁটির শক্তি নিহিত আছে বিশ্বের ক্ষমতাধর এক রাষ্ট্রের হাতে। সেই রাষ্ট্রের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং সেই মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া যে বিশ্বব্যাংকের বৃহৎ কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে না তা খুব সহজেই অনুমেয়। বিশ্বব্যাংক যে সেই রাষ্ট্রের সম্মতি পেয়েই এভাবে বাংলাদেশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে—তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। এ রকম একটু আভাস তো আইএমএফের প্রধানের বক্তব্যের মধ্যেও পাওয়া যায়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নতি ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এই আয়োজন এবং সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অতীতে সৃষ্ট ভুল-বোঝাবুঝির আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে। যেকোনো কারণেই হোক বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটা সময় ভুল বুঝেছিল এবং একটি ভুল সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য কষ্টের। কিন্তু বিশ্বব্যাংক অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই ভুল বুঝতে পেরেছে এবং তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে বিষয়টি সুরাহা করে বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন এবং সামাজিক প্রকল্পে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। বিষয়টি আগেই সুরাহা হলেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে সেই ভুল-বোঝাবুঝির আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে। এখন থেকে এই বিষয়টি আর সামনে না আনাই ভালো। বাংলাদেশের জন্য এটি ভুলে থাকা কষ্টকর। তার পরও অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে অনেক কিছুই ভুলে থাকতে হয় এবং বাংলাদেশকেও এটা ভুলে থাকতে হবে। এ ছাড়া আমরা তো নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে উপযুক্ত জবাব দিয়েই দিয়েছি। পদ্মা সেতুই আমাদের হয়ে কথা বলেছে এবং আগামী দিনেও বলবে। তাই আমাদের বারবার অতীত গ্লানি টেনে সম্ভাব্য তিক্ততার পটভূমি রচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
কানাডার একটি নামকরা নির্মাণ কম্পানি এসএনসি লাভালিনও বিশ্বব্যাংকের সেই ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছিল। এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর একটি অংশের কাজ করতে চেয়েছিল এবং সেই কম্পানির নাম জড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের ভুল-বোঝাবুঝির সূত্রপাত। সেই কম্পানির নাম জড়িত থাকার কারণেই কানাডার আদালতে মামলা হয়েছিল এবং সেই মামলার রায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যায়। কানাডার এসএনসি লাভালিনকে জড়িয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছিল তা আদালতে ভুল প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও এসএনসি লাভালিন কিন্তু আজ পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করেনি। বাংলাদেশ তবু পদ্মা সেতু নির্মাণে সফল হয়েছে; কিন্তু একই মিথ্যা অভিযোগের শিকার হয়ে এসএনসি লাভালিন কাজটাও পায়নি, তার পরও তারা এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক কি শুধু নিজেদের ভুল বুঝে বা কোনো একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সমর্থনে বাংলাদেশের প্রতি এমন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে? বিষয়টি মোটেই এত সহজ নয়। এখানে অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে। প্রথমত, বিশ্বব্যাংক পৃথিবীতে যত দেশের উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যারা অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের ঋণ ব্যবহার করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সফলতা দেখানো এবং সেই ঋণ নিয়মিত পরিশোধে বাংলাদেশ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিগত ১৫ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশ ছাড়া দ্বিতীয় একটি রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এ কারণেই অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের কাছে রাখা প্রয়োজন। এর ওপর আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনের সমন্বয়ে গঠিত জোটের অধীনে সৃষ্ট ব্রিকস ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর বিষয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ব্রিকস ব্যাংকের জন্ম। আজকের বিশ্বরাজনীতিতে যে অস্থিরতা তার সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে, যখন এই ব্রিকস ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। অবশেষে বিশ্বরাজনীতির এই ডামাডোলের মধ্যে ব্রিকস ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। এই ব্যাংকের ব্রাজিলিয়ান প্রধান এরই মধ্যে সদস্য দেশগুলোকে ঋণ সুবিধা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন এবং এটাও নিশ্চিত করেছেন যে প্রয়োজনে ৩০ শতাংশ ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় প্রদান করা হবে। নিশ্চয়ই ব্রিকস ব্যাংকের এই অগ্রগতির খবর বিশ্বব্যাংকের কাছে যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের পেছনের শক্তির কাছেও। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাংক চাইবে যে তাদের আর্থিক সহযোগিতা নেওয়া দেশগুলো যেন কোনোভাবেই এই ব্রিকস ব্যাংকের দিকে অতি মাত্রায় ঝুঁকে না পড়ে। এ কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণের যে চমৎকার এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে হবে অতি সতর্কতার সঙ্গে।