বিরোধী দলের আপত্তি ও কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ‘রিপ্রেজেনটেশন অব পিপল (সংশোধনী) বিল-২০২৩’ পাস করা হয়েছে। বিলের পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম বলেছেন, বিলটি পাসের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন-ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। এই কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর জনগণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় বলে দাবি করেছেন গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। বিলের উপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠনোর প্রস্তাব দেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, গণফোরাম ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।
প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা নির্বাচন পরিচালনায় ইসির ক্ষমতা খর্ব, নির্বাচনে ঋণখেলাপীদের বিশেষ ছাড় প্রদানসহ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সরকার এই বিলটি পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা বিলটি পাসে আপত্তি জানালেও তাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।
সংসদে পাস হওয়া নির্বাচনী আইনটিতে প্রস্তাবিত সংশোধনে ৯১ (ক) অনুচ্ছেদে একটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। আগে বিলের ৯১(এ) ধারায় ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয়, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমত সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
এর সঙ্গে যুক্ত করে নতুন উপধারায় বলা হয়েছে, শুধু কয়েকটি কেন্দ্রের গোলযোগ-জবরদস্তির জন্য পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা যাবে না।
সেই সব কেন্দ্রের ভোটই বন্ধ করা যাবে, যেসব কেন্দ্রের ভোট গ্রহণে অভিযোগ নেই, তা স্থগিত করা যাবে না। এতে ইসির ক্ষমতা খর্ব হয়েছে বলে বিরোধীদলের সদস্যরা দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইসির নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
বিলটি পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, বিলটি পাসের মাধ্যমে ইসি পুরো নির্বাচনী এলাকা বন্ধ করতে পারবে না, এমন বিধান করা হচ্ছে। বিলটি পাস হলে শুধু কেন্দ্রগুলো যেখানে গণ্ডগোল হয়েছে, সেখানে বন্ধ করতে পারবে।
এটা ইসির স্বাধীতায় হস্তক্ষেপ। কারণ ইসি যদি মনে করে কোনো আসনে অনেক গণ্ডগোল হবে, পরিবেশ খারাপ আছে, তাহলে তারা সেখানে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে। গত ৫২ বছর সেটাই চলে আসছে। এখন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে? সরকারের আজ্ঞাবহ এই কমিশনের অধীনে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব না। তিনি আরো বলেন, আগে ঋণখেলাপী মনোনয়ন জমা দেওয়া সাত দিন আগে ঋণ পরিশোধের বিধান ছিল। এখন সেটা একদিন আগে করার মাধ্যমে ঋণখেলাপীদের নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিপন্থী। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরপিও সংশোধনের বিলটি আনা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বিলটি আনা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে আইন করা হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে। যে কারণে প্রত্যেকটা জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরা আরপিওর কিছু সংশোধন করে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য আরপিও সংশোধনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। বর্তমান সরকারের সময় নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যে মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়েছে। মানুষ আজ ভোট কেন্দ্রে যেতে চায় না। অবশ্য এর জন্য যারা আজকে সরকার উৎখাতের আন্দোলন করছে তারা কম দায়ী না। তাদের সময়ও তারা ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য এক কোটি ২০ লক্ষ ভুয়া ভোটার তালিকাভূক্ত করেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে ওয়ান ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, যারা ক্ষমতায় আছেন তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে চান, আর যারা ক্ষমতা থেকে একবার বিতারিত হয়েছেন তারা আবার যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তার ভোটের অধিকার চায়, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। দলীয় প্রশাসন ও দলীয়করণ থেকে অব্যাহতি চায়। তারা ভোট চোরকে চায় না, ভোট ডাকাতকেও চায় না। সংবিধান অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায় তারা।
বিরোধীদলের বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, জোর জবরদস্তি, গোলযোগ, সহিংসতায় তদন্ত সাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে একটি কেন্দ্রে গণ্ডগোলের কারণে পুরো আসনে নির্বাচন বন্ধে মানুষের অধিকার লংঘন হয়। তাই বিষয়টি স্পষ্ট করতে আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। যাতে যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে পারবে। একই আসনের যেখানে সঠিক নির্বাচন হয়েছে, তা বন্ধ করার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এটাকে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি, বরং ইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে।
পাস হওয়া বিলে টিআইএন এবং ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের কপি জমা, প্রার্থিতা বাছাইয়ে বৈধ হলেও তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ, দল নিবন্ধনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করা এবং ভোটের সংবাদ সংগ্রহে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের কাজে বাধা দিলে কিংবা যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করলে শাস্তি-সাজার বিধান রাখা হয়েছে।