Thursday , 21 November 2024
E- mail: news@dainiksakalbela.com/ sakalbela1997@gmail.com
ব্রেকিং নিউজ
বিপ্লবের দায় ও সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আলোচনা
--সংগৃহীত ছবি

বিপ্লবের দায় ও সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আলোচনা

অনলাইন ডেস্কঃ

সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য এবং আইনি সমর্থন অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্যের জন্য রাজনৈতিক দল-মতের মধ্যে সমঝোতার পথ হচ্ছে অব্যাহত আলোচনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় দফা আলোচনা তারই প্রতিফলন। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর অগ্রগতি বক্তৃতা-বিবৃতিতে যতটা না প্রতিফলিত হয়, তার চেয়ে বেশি বোঝা যাবে ভবিষ্যতে দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

এসব আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতার একটি অঙ্গীকারনামা প্রকাশ করা হলে ভবিষ্যতে সামনে অগ্রসর হওয়ার পথনির্দেশনা দৃঢ় ভিত্তি পাবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।

দ্বিতীয় বিষয় আইনি প্রক্রিয়া। বিদ্যমান আইন দিয়ে সংস্কার হয় না, সংস্কারের জন্য দরকার হয় নতুন আইন। সংসদ না থাকলে এ আইন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে হয়, সংসদ পরে তা পাস করে নেয়।

এই সরকারের অধিষ্ঠানই আইন ভঙ্গ করে। এই অধিষ্ঠানের জন্য আইন উপেক্ষার নিয়ামক হিসেবে বলতে হচ্ছে, তারা এসেছে বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান কোনো প্রচলিত আইন মেনে হয় না। সংবিধানেও তেমন কিছু লেখা থাকে না।

বিপ্লবের দায় ও সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আলোচনাঅন্যদিকে বিপ্লবী সরকারের চরিত্র প্রকাশ পায় অতীতের দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করার মানসিক ঔদ্ধত্যে। এই ঔদ্ধত্যের বলে বলীয়ান হয়েই তারা বলতে পারে, প্রয়োজন অনুযায়ী যা করা হবে, সেটিই আইন। এমন আইন একটি-দুটি না, যখন যা প্রয়োজন, সেটি করতে গিয়ে অনেকও হতে পারে। যেখানে যা প্রয়োজন, তাত্ক্ষণিকভাবে তা করে ফেলবে। সংস্কার বা বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে নতুন আইন বানিয়ে নেওয়াই নিয়ম।

অথচ সরকার চলছে প্রথামাফিক আইনকানুন, রীতি, ল বাই ল দিয়ে! আগের নিয়মেই সচিব নথি-ফাইল পুটআপ করবেন এবং সেখানে নোট দেওয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্যও থাকবে। ‘ওয়ান ফাইন মর্নিং’ ঘুম থেকে উঠে নিজেকে উপদেষ্টার চেয়ারে অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ার অনুভূতি কখনোই বিপ্লবের শক্তি অর্জন করতে পারে না। রাতারাতি কেউ এই বিপ্লবী চরিত্র ধারণ করতে পারে না, এই সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বিপ্লবের প্রশ্নে প্রধান বিবেচ্য বিপ্লবকারী এবং তাঁর লক্ষ্য। বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সংগঠন নয়, এটি একটি প্ল্যাটফরম বা মঞ্চ, যেখানে নানা মত ও মতলবের মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা হ্রাস করার দাবিতে। পরে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে এক দফার একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। নামকরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় শুরুতে এটি ছিল ছাত্রদের‌ই আন্দোলন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের লোক নন। নানা জায়গা থেকে এসেছেন। ঐক্যের সূত্র ছিল, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার বা সাংবিধানিক রীতিনীতি পরিবর্ধন বা পরিমার্জনের অঙ্গীকারে জনমত সংগঠিত করা হয়নি। সে এজেন্ডাই ছিল না। ছিল না বলেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংস্কারের তাগিদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন সুযোগ? ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী তৈরির পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে সংস্কার করার সুযোগ। আর এ জন্যই বিপ্লবের কাভার নেওয়ার চেষ্টা।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যে সংবিধানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই সংবিধানে কোনো অন্তর্বর্তী বা কেয়ারটেকারের সিস্টেম নেই। নতুন একটি সংসদে সদস্যদের শপথ নেওয়া পর্যন্ত আগের সংসদ ভেঙে গেলেও কার্যকর থাকে।

আওয়ামী লীগ সংবিধানকে এমন টাইট করে সেট করেছে যে এর আওতায় বর্তমান সরকারের কোনো বৈধতা নেই। নির্বাচন ছাড়া কারো ক্ষমতায় আসার কোনো সুযোগ নেই। বিচারকদের অভিসংশনে সংসদের ক্ষমতা, সংবিধানে জাতির পিতার অসম্মানে শাস্তির বিধান ইত্যাদি নিয়ে আওয়ামী লীগ আমলে প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে অনেক কিছু ঘটে গেছে। শেষ পর্যন্ত এসব কঠোর বিষয় সংবিধানে এখনো কার্যকর রয়ে গেছে।

বর্তমান সরকার বিপ্লবের নামে এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ এনে তার টেকওভার জাস্টিফাই করে নিয়েছে। এর পরও লঙ্ঘনের বিষয়টি পরবর্তী সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির মাধ্যমে আরো বৈধ করে নিতে হবে। সেই সঙ্গে সংবিধান নতুন করে লেখা হবে কিংবা বিদ্যমান সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু তাতেও ঝামেলা থেকেই যাচ্ছে।

ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ আবার দৃশ্যপটের মূলে আসবে এমন আশা বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় দুরাশা। যদি আসে, তাহলে তারা একইভাবে রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট দিয়ে সবই ফিরে পেতে পারবে। সংবিধানে তারা যে ধারাগুলো যুক্ত করে গেছে, তা এমনভাবে করেছে, যার ফলে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো কিছু করার নেই। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেলেও অসহায় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে পলায়নপর টাকা কামানো এমপিদের নিয়ে সংসদের অধিবেশন ডেকে ওখানে সাংবিধানিক জটিলতা ফায়সালা করে নেওয়া দরকার ছিল। বিজয়ের আবেগচালিত হয়ে সুযোগ থাকার পরও যা করা হয়নি, তা নিয়ে এখন অনুশোচনা হতে পারে।

অবশ্যই জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। কিন্তু সমস্যাটি হয়ে গেছে প্রসিডিউরাল (procedural), যেটি আওয়ামী লীগ যথেষ্ট স্টাডি করেই করেছে। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত যা চলছে, তার কোনোটিই সংবিধানের দৃষ্টিতে চলার বিধান নেই। তার পরও এই সাংবিধানিক ব্যবস্থার ওপর সরকারকে অবস্থান করতে হচ্ছে। রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট দিয়ে নতুন সংবিধান কিংবা সংবিধান সংশোধন করে এই ত্রুটি দূর করা হলেও দূর ভবিষ্যতে এই জ্বর আবারও আসবে। তখন আবার হয়তো নতুন সমন্বয়কদের প্রয়োজন হবে।

এ জন্যই বর্তমান সরকারের অবস্থান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। অধ্যাপক ইউনূস সরকারের পলিটিক্যাল লেজিটিমেসি থাকলেও কনস্টিটিউশনাল লেজিটিমেসি নেই, যা আগের সরকারের ঠিক বিপরীত! সাংবিধানিক উত্তরাধিকারী সরকারের পক্ষে সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব কিছু করে নেওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বলাই যায় যে সংবিধান আসমানি কিতাব নয়। তাই শাসকপক্ষ নিজেদের প্রয়োজনে এর সংশোধন, পরিমার্জন করে যেকোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে। সুতরাং সংবিধান কোনো বিষয় না, গুরুত্বপূর্ণ হলো কে ক্ষমতায় আছে এবং তারা কী করতে চায়।

এ জন্যই বোধ করি সরকারপ্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘I am not in the running business.’

অর্থাৎ পরিষ্কার করেই বলেছেন, তিনি সরকারের শাসনকার্য চালাতে আসেননি। তিনি এসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে, যে সরকার পরবর্তী সরকারের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কারের আউটলাইন দিয়ে যাবে।

নিজেকে বিতর্কিত না করতে এটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। ঝুঁকিটি ভবিষ্যতের নির্বাচিত দলীয় সরকারই নিক।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ জন্যই তিনি সংস্কারের জন্য তাঁর নিয়োগকর্তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে বিষয়ভিত্তিক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। কোনো কমিশন কখনোই নিজে সংস্কার করে না। সুপারিশ করে মাত্র। বাস্তবায়ন করা বা না করার দায় সরকারের। আর এই বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ক্ষমতার গুরুত্ব অপরিহার্য। নিঃসন্দেহে এই ক্ষমতা নিতে হলে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য, যা সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক মতপথের ভিন্নতা নির্বিশেষে আলোচনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সেই রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাধুবাদ প্রাপ্য।

লেখক : সাংবাদিক

About Syed Enamul Huq

Leave a Reply