সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য এবং আইনি সমর্থন অপরিহার্য। জাতীয় ঐক্যের জন্য রাজনৈতিক দল-মতের মধ্যে সমঝোতার পথ হচ্ছে অব্যাহত আলোচনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় দফা আলোচনা তারই প্রতিফলন। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর অগ্রগতি বক্তৃতা-বিবৃতিতে যতটা না প্রতিফলিত হয়, তার চেয়ে বেশি বোঝা যাবে ভবিষ্যতে দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
তবে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবেই শুধু নয়, দেশে-বিদেশে একজন শ্রদ্ধেয় ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই উদ্যোগ নিশ্চিতভাবেই অভিভাবকসুলভ। আলোচনা থেকে প্রাপ্তি হিসেবে সংস্কার প্রশ্নে একটি যৌথ বিবৃতি জাতিকে আশান্বিত করতে পারে, যার মাধ্যমে সর্বদলীয় একটি অঙ্গীকার প্রকাশ করা হলে তাঁর এই সমঝোতা প্রচেষ্টা হতে পারে ঐতিহাসিক। ‘তিন জোটের রূপরেখা’র মতো একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দলিল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনের পর সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনসহ কিছু সংস্কারে সব রাজনৈতিক দলকে বাধ্য করেছিল। এই অতীত অভিজ্ঞতা সামনে রেখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেওয়া আলোচনার উদ্যোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় বিষয় আইনি প্রক্রিয়া। বিদ্যমান আইন দিয়ে সংস্কার হয় না, সংস্কারের জন্য দরকার হয় নতুন আইন। সংসদ না থাকলে এ আইন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে হয়, সংসদ পরে তা পাস করে নেয়।
অথচ সরকার চলছে প্রথামাফিক আইনকানুন, রীতি, ল বাই ল দিয়ে! আগের নিয়মেই সচিব নথি-ফাইল পুটআপ করবেন এবং সেখানে নোট দেওয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্যও থাকবে। ‘ওয়ান ফাইন মর্নিং’ ঘুম থেকে উঠে নিজেকে উপদেষ্টার চেয়ারে অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ার অনুভূতি কখনোই বিপ্লবের শক্তি অর্জন করতে পারে না। রাতারাতি কেউ এই বিপ্লবী চরিত্র ধারণ করতে পারে না, এই সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বিপ্লবের প্রশ্নে প্রধান বিবেচ্য বিপ্লবকারী এবং তাঁর লক্ষ্য। বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সংগঠন নয়, এটি একটি প্ল্যাটফরম বা মঞ্চ, যেখানে নানা মত ও মতলবের মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা হ্রাস করার দাবিতে। পরে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে এক দফার একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। নামকরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় শুরুতে এটি ছিল ছাত্রদেরই আন্দোলন।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যে সংবিধানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই সংবিধানে কোনো অন্তর্বর্তী বা কেয়ারটেকারের সিস্টেম নেই। নতুন একটি সংসদে সদস্যদের শপথ নেওয়া পর্যন্ত আগের সংসদ ভেঙে গেলেও কার্যকর থাকে।
বর্তমান সরকার বিপ্লবের নামে এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ এনে তার টেকওভার জাস্টিফাই করে নিয়েছে। এর পরও লঙ্ঘনের বিষয়টি পরবর্তী সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির মাধ্যমে আরো বৈধ করে নিতে হবে। সেই সঙ্গে সংবিধান নতুন করে লেখা হবে কিংবা বিদ্যমান সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু তাতেও ঝামেলা থেকেই যাচ্ছে।
অবশ্যই জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। কিন্তু সমস্যাটি হয়ে গেছে প্রসিডিউরাল (procedural), যেটি আওয়ামী লীগ যথেষ্ট স্টাডি করেই করেছে। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ৫ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত যা চলছে, তার কোনোটিই সংবিধানের দৃষ্টিতে চলার বিধান নেই। তার পরও এই সাংবিধানিক ব্যবস্থার ওপর সরকারকে অবস্থান করতে হচ্ছে। রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট দিয়ে নতুন সংবিধান কিংবা সংবিধান সংশোধন করে এই ত্রুটি দূর করা হলেও দূর ভবিষ্যতে এই জ্বর আবারও আসবে। তখন আবার হয়তো নতুন সমন্বয়কদের প্রয়োজন হবে।
এ জন্যই বোধ করি সরকারপ্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘I am not in the running business.’
নিজেকে বিতর্কিত না করতে এটি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত। ঝুঁকিটি ভবিষ্যতের নির্বাচিত দলীয় সরকারই নিক।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ জন্যই তিনি সংস্কারের জন্য তাঁর নিয়োগকর্তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে বিষয়ভিত্তিক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। কোনো কমিশন কখনোই নিজে সংস্কার করে না। সুপারিশ করে মাত্র। বাস্তবায়ন করা বা না করার দায় সরকারের। আর এই বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ক্ষমতার গুরুত্ব অপরিহার্য। নিঃসন্দেহে এই ক্ষমতা নিতে হলে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য, যা সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক মতপথের ভিন্নতা নির্বিশেষে আলোচনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সেই রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাধুবাদ প্রাপ্য।
লেখক : সাংবাদিক