অনলাইন ডেস্কঃ
প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। এর মধ্যে বহুবার দলটি সংকটের মধ্যে পড়লেও এক-এগারোর পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পড়া সংকটের ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। গত তিনটি নির্বাচনেই ক্ষমতার বাইরে আছে দলটি। তারেক রহমান হাল ধরলেও বিএনপিতে এক ধরনের নেতৃত্বের সংকট রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছে।
কিন্তু এমন বিপর্যয়ের পরও রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এখনো এ দেশে প্রাসঙ্গিক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে টিকে আছে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক মেরুকরণ এখনো বিদ্যমান। কারণ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তির পাশাপাশি এক-এগারো পরবর্তী সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ বিরোধী বড় কোনো প্ল্যাটফর্ম দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এখনো বিকল্প হিসেবে বিএনপিকেই ভাবে। মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে নেতৃত্বের কাঠামো দুর্বল করা গেলেও দলটির জনসমর্থন কমানো যাচ্ছে না বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। সে কারণেই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাথাব্যথা নেই। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মূল টার্গেট এখনো বিএনপিই।
অনেকের মতে, জিয়াউর রহমানের ইমেজের ওপর তৈরি হলেও বিএনপির পরবর্তী নেতৃত্ব সেটি ধরে রাখতে পারেনি। ২০০১ সাল-পরবর্তী বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠার সময়ে ভারতবিরোধী এবং চীন, মুসলিমবিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থননির্ভর দল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে দলটির ওই অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে বিএনপির এখনকার অবস্থান অনেকটাই অস্পষ্ট। বিএনপিপন্থী সুধীসমাজের বড় অংশই মনে করে, ভারতমুখী হলে দলটির জনপ্রিয়তা কমে যাবে। আবার আরেক অংশ মনে করে, ভারতের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এক-এগারোর তাৎপর্য বুঝতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনও দলটি আদায় করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের পরও জামায়াতের সঙ্গে জোট ধরে রাখার ঘটনাকে বড় ধরনের ভুল বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে ৩৬ বছর নেতৃত্বদানকারী চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়া দলটিকে মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি এখন রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে। আগামী দিনে তিনি রাজনীতি করবেন কি না, তা নিয়েও দলে অনিশ্চয়তা আছে। আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি ভবিষ্যতে কতটা এগিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে।
নেতাদের একাংশের পাশাপাশি সমর্থক সুধীসমাজের কেউ কেউ মনে করেন, গত দেড় যুগে সঠিকভাবে দল পরিচালনা, এক-এগারোর পর উদ্ভূত সংকট মোকাবেলা এবং পরবর্তী সময়ে নির্বাচন ও আন্দোলন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএনপি বড় ধরনের ভুল করেছে। প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরে এসে তাই বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্তহীনতার এমন ধারাবাহিকতা চললে আগামী দিনে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হবে।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মত ও পথের অনুসারীদের একত্র করে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। করোনাভাইরাস মহামারির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে আজ মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে। এ উপলক্ষে সকালে কেন্দ্রীয় ও জেলা কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, শেরেবাংলানগরে জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভার্চুয়াল আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে।
সুধীসমাজে বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ডা. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, ‘জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদার বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।’ তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান শুধু ভারত নির্ভরতা না রেখে চীন ও মুসলিমবিশ্বসহ বিএনপির রাজনীতিকে বহুমুখী করেছিলেন। খালেদা জিয়াও একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী নেত্রী। অথচ বিএনপির কেউ কেউ এখন মনে করেন যে ভারতের আনুকূল্য পেলেই ক্ষমতায় যাওয়া যাবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। ভারত বিএনপিকে আস্থায় নেবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন মনে করেন, ‘এক-এগারো থেকে শুরু হওয়া ষড়যন্ত্রের এখনো ধারাবাহিকতা চলছে এবং এ কারণেই বিএনপিকে নানা কৌশলে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সময়ের পরীক্ষায় আজ এটা প্রমাণিত হয়েছে যে বিএনপি এ দেশে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল এবং আজও এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘অনেকেই অনেকভাবে বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সফল হয়নি। বিএনপি জনগণের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি এখনো ফ্যাক্টর। কারণ আওয়ামী লীগ জানে সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি জয়লাভ করবে।’ তাঁর মতে, ‘এই ভোট জনগণ বিএনপিকে পছন্দ করে দেবে, তা নয়। আওয়ামী লীগের ওপর যারা ক্ষুব্ধ বা তাদের সরাতে চায় এমন লোকেরাই বিএনপিকে ভোট দেবে। জনগণের পারসেপশনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই এখনো বড় রাজনৈতিক দল।’ তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বের যে সংকটের কথা এখন বলা হচ্ছে, সেটি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে থাকবে না। নেতৃত্বের সংকট বোঝা যায় ক্ষমতায় না থাকলে।’
বিএনপি প্রথমে সংকটে পড়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। ওই পরিস্থিতিতে কিছু সময়ের জন্য দলের হাল ধরেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। কিন্তু পরের বছর ২৪ মার্চ জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে আবদুস সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় বিএনপি আরেক দফা সংকটে পড়ে। দলের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা ওই সময় এরশাদের সঙ্গে চলে গেলে সংকট আরো বাড়ে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় যায়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সিদ্ধান্তহীনতা ও বেশ কিছু ভুলের জন্য দলটির শক্ত ভিতে চিড় ধরে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০০২ সালের ২০ জুন চাপের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা, মন্ত্রিত্ব না পাওয়াসহ নানা কারণে ক্ষুব্ধ ২৪ জন মন্ত্রী-এমপির জোট সরকারের শেষ সময়ে ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর বিএনপি থেকে পদত্যাগের ঘটনা। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েও বিএনপি সে সময় নানা কৌশল গ্রহণ করে এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান পদে বসায়। অনেকের মতে, দুর্বলচিত্তের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের জায়গায় অন্য কেউ রাষ্ট্রপতি থাকলে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বেরিয়ে আসতে পারত। আর এমন পরিস্থিতিতে এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা কম ছিল।
আবার এক-এগারোর প্রস্তুতি সরকারে থাকতে আঁচ করতে না পারার ঘটনাও বিএনপি সরকারের অদক্ষতার পরিচায়ক বলে কেউ কেউ মনে করে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ওই সরকারের রোষানলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিএনপি। এরপর নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দলে মতবিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে যায় এবং ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। কিন্তু পরে দলটির আত্মোপলব্ধি হয় যে নির্বাচনে যাওয়া ভুল ছিল।
একইভাবে আন্দোলনের মাঠ নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করা আরেকটি বড় ভুল সিদ্ধান্ত বলে বিএনপির একাংশ এখন মনে করছে। সর্বশেষ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে ইতিবাচক কোনো ফলাফল না পেয়ে এবং নির্বাচনী মাঠ দখলের প্রস্তুতি না নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ দলটির সর্বশেষ কৌশলগত ভুল বলে মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলে রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এ দেশে তথাকথিত এক-এগারোর পর যা ঘটেছে তা হলো বিএনপি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র।’ ‘এটি আজ প্রমাণিত যে অনেক অত্যাচার-নির্যাতনের পরও বিএনপিকে দুর্বল করা যায়নি। এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপি আজও প্রাসঙ্গিক এবং সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর অনেকবার সংকটে পড়লেও বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আগামীতেও ঘুরে দাঁড়াবে।’