অনলাইন ডেস্ক:
২২ মার্চ ১৯৭১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই দিনটি একটি অনন্য দিন। গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও সরাসরি যুক্ত হয়ে যায় স্বাধীনতাসংগ্রামের নানা মাত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে। ঢাকার প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। ‘বাংলার স্বাধিকার’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র। ক্রোড়পত্রে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বাণী প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বাণীটি হাতে লেখা।
বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট বন্দুক বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবে না। কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
ক্রোড়পত্রে প্রবন্ধ লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহান, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ক্রোড়পত্রটির পরিকল্পনা করেছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপী অ্যাডভার্টাইজার্স। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
ক্রোড়পত্র প্রকাশের পরিকল্পনা সম্পর্কে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সরকার ক্রোড়পত্র করতে পারে, সেখানে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারে, তার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরার জন্য এই ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আমরা সাহস করে মানুষের মনের কথা বলতে পেরেছিলাম।’ তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর বাণীটির হস্তাক্ষর ছিল তাঁর (রামেন্দু মজুমদারের)। বাণীর নিচে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন। ক্রোড়পত্রটি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হকের পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার ছাপাতে অস্বীকার করে। তবে পরদিন সেটি ছেপেছিল ‘বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে। বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই এই ক্রোড়পত্রটি ছাপা হয়েছিল।
রামেন্দু মজুমদার আরো জানান, একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর যে বিচার শুরু হয়েছিল, তাতে বিটপীর কর্ণধার রেজা আলীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ইন্ধনেই এই ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে বলে তাঁকে বলতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকাকে ‘৫০ বছরের পেশাগত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ’ বলে মনে করেন রামেন্দু মজুমদার। ক্রোড়পত্রটি জনমনে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে।
অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিনে জনতার জাগরণ বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় পৌঁছায়। দৈনিক পূর্বদেশের প্রতিবেদনে পাওয়া যায় সেদিনের চিত্র। পত্রিকাটিতে লেখা হয়, ‘সোমবার ২২শে মার্চ শপথে শপথে প্রদীপ্ত দিন। প্রহরগুলো শুধু নয়, প্রতিফল যেন সংগ্রামের দুর্জয় প্রত্যয়ের এক একটি মৃত্যুঞ্জয় পতাকা হয়ে ৩২ নম্বর সড়ককে আন্দোলিত করেছে। এত প্রাণাবেগ, এত ভাবাবেগ, এত উত্তাপ একদিনে এতবার এসে সঞ্চারিত হয়নি। জনতার এত জোয়ার এর আগে আছড়ে পড়েনি একদিনে এতবার ৩২ নম্বর সড়কে।’ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে শোভাযাত্রার বহমান জনতার স্রোতধারার ভিড়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২৪ বছর বাঙ্গালি শুধু মার খেয়েছে। আর মার খেতে রাজি নই। আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান। আর কোনো পঙ্গপালকে আমরা বাংলার সম্পদ নষ্ট করতে দেব না। সে পঙ্গপাল বিনাশের জন্যেই আমার জন্ম। আমার রক্ত দিয়ে আমি আপনাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করব।’
গণ-আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নেমে আসেন বাঙালি সাবেক সৈনিক-সেনা কর্মকর্তারাও। স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য তাঁরা শপথ গ্রহণ করেন। বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মেজর জেনারেল (অব.) এম আই মজিদ। পরিচালনা করেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী এমএনএ।
প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া খান-বঙ্গবন্ধুর বৈঠকে যোগ দিলেন পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রায় সোয়া ঘণ্টা বৈঠক হলো তাঁদের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি, আমার দাবি (চার দফা) পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে পারি না।’
পিপিপি নেতা ভুট্টো খুব ব্যস্ততম দিন কাটান। দলীয় উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক, প্রেসিডেন্ট ভবনে ছোটাছুটির মধ্যে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ারও আভাস পাওয়া যায়। রাতে হোটেল লাউঞ্জে এক অনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘আমরা চাই সর্বজনগ্রাহ্য একটি সমঝোতা। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার আগে আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীও একটি পক্ষ। কারণ তারা ক্ষমতায় এবং তারাই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।’
পরদিন ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকে।