অনলাইন ডেস্ক:
একরোখা। মারমুখী। নাছোড়। এর একটিকেও বাদ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনা যায় না। ছাত্ররাজনীতির আঙিনা থেকে সর্বশেষ ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনী ময়দান—সবখানেই মমতা তাঁর জাত চিনিয়েছেন।
বাবা শিশির অধিকারীসহ দুই ছেলে শুভেন্দু ও সৌমেন্দু বহুদিন থেকেই নন্দীগ্রামের রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন। এই অধিকারী পরিবার এবার বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাল। মমতা এতটুকু ভড়কালেন না। অধিকারী পরিবারের ছোড়া চ্যালেঞ্জ লুফে নিলেন। আজকের মমতা হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তাঁর এই মারমুখী ভঙ্গি, একরোখা মনোভাব ও নাছোড় প্রবণতা। তিনি চ্যালেঞ্জ ভালোবাসেন।
আর এসবের রসায়নই এবারও তাঁর নিজ হাতে গড়া দল তৃণমূলকে তৃতীয় দফায় জয়ের স্বাদ দিল। ‘বাঘের ডেরায়’ গিয়ে মমতা নিজে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হারলেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দলকে বিজয়ী করার কৃতিত্ব তাই আরো বড় হয়ে ওঠে। কেননা ‘বাংলা দখলে’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তবু ভোটের লড়াইয়ে তাঁরা পেরে উঠলেন না হুইলচেয়ারে বসে প্রচারাভিযান চালানো মমতার সঙ্গে। মমতা আবার প্রমাণ করে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিনি এখনো অপরাজেয় এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিরও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তিনিই এই মুহূর্তে বিজেপিবিরোধী সবচেয়ে উচ্চকিত কণ্ঠ।
শেষের এই গল্পের মতো মমতার শুরুর দিনগুলোও অভিন্ন লড়াই-সংগ্রামে ভরা। গত শতকের সত্তরের দশকে মমতার রাজনৈতিক জীবন শুরু কংগ্রেসের সাধারণ একজন কর্মী হিসেবেই। কিন্তু শুরুতেই তাঁর মধ্যে অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
১৯৭৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন। কয়েক বছর পর হন নিখিল ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। বড় ‘অঘটন’ ঘটান ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে সোমনাথ চ্যাটার্জির মতো প্রবীণ সিপিআই (এম) নেতাকে হারিয়ে।
এই সাড়া-জাগানো বিজয় মমতাকে ভারতের অন্যতম কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব এনে দেয়। পরে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসবিরোধী হাওয়ার মধ্যে তিনি অবশ্য একই আসনে হেরে যান। তবে দুই বছর পর, ১৯৯১ সালে ফের নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় ফেরেন। পরে আরো পাঁচবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মমতার এই পুরো যাত্রাপথে তাঁর লড়াকু ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একই সঙ্গে তাঁকে ‘প্রতিবাদী’ রাজনীতিক হিসেবেও সমান পরিচিত করে তোলে।
নিজ দলের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)-কে সহায়তার অভিযোগ, পার্লামেন্টে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, একজন এমপির সঙ্গে হাতাহাতি, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে’ রেলমন্ত্রীর দিকে শাল ছুড়ে মারা, এমপি পদ থেকে ইস্তফা ইত্যাদি নানা ঘটনায় আলোচিত হন মমতা।
মমতা প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হন ১৯৯১ সালে। পরে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ১৯৯৯ সালে। সে সময় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের অংশ হয়েছিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল তৃণমূল কংগ্রেস।
এর আগের বছর কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কিছুকালের মধ্যেই এটি পরিণত হয় বামফ্রন্টশাসিত পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে। ২০০৫ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের জন্য কৃষিজমি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ মমতার নেতৃত্বকে এতটাই পোক্ত করে যে তৃণমূল কংগ্রেস হয়ে ওঠে শাসকদের ‘দুঃস্বপ্ন’। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি রক্ষায় গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মমতা জনগণের মধ্যে বামফ্রন্টবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা করে তোলেন। বামফ্রন্টকে মোকাবেলা করার নেতৃত্ব ও সাহস দেখানোর পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণের ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করতেও সক্ষম হন মমতা। অর্থাৎ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক ভিত তৈরি হয়। মমতা এখনো সেই ভিতে দাঁড়িয়ে।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বামফ্রন্টের চেয়ে বেশি আসন পায় তৃণমূল। এর দুই বছর পর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টকে পরাজিত করে। মমতা হন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। এর পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায়।
কংগ্রেসে হাতেখড়ি হওয়ায় মমতার রাজনৈতিক দর্শন হয়তো কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী ধারার সঙ্গে মেলে। এ জন্য তাঁকে ‘জনতুষ্টিবাদী নেতা’ (পপুলিস্ট) আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তবে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি যেসব সেবা মানুষের বিনা পয়সায় পাওয়া উচিত, তার জন্য লড়ছেন মমতা। এটাই তাঁর আদর্শিক অবস্থান, যা কংগ্রেসেরও মূলনীতি।
মমতা রাজ্যের দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য নানা রকম জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছেন। এগুলো একদিকে প্রশংসিত হয়েছে, অন্যদিকে সেগুলো ‘পপুলিস্ট কর্মসূচি’ হিসেবেও সমালোচিত। দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই। বামফ্রন্টের সময়কার ট্রেড ইউনিয়ন-রাজের অবসান ঘটলেও রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ আসেনি, নতুন কর্মসংস্থানও সেভাবে হয়নি। এ ছাড়া মমতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু বিশেষ করে ‘মুসলিম তোষণের’ অভিযোগও আছে।
তবে এ কথাও ঠিক, তৃণমূল কংগ্রেস একান্তভাবেই মমতার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দল। এর কাঠামো যেমন সুদৃঢ় নয়, তেমনি সুনির্দিষ্ট কোনো আদর্শের ভিত্তিতেও তৈরি হয়নি। মমতার বিরল ক্ষমতা রয়েছে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের। ফলে পরিবার, পড়াশোনা সবই সাদামাটা হওয়ার পরও তিনি সফল রাজনীতিবিদ। ১৯৫৫ সালে কলকাতার হাজরা এলাকার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে মমতার জন্ম। ফলে আটপৌরে ব্যাপারটা তাঁর মধ্যে আছে। সাধারণ মানুষও এটাকে পছন্দ করেছে। তাঁকে সহজেই পাশের বাড়ির মেয়ে ভাবা যায়; আপনার জন ভাবা যায়। এ কারণে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় মমতাকে ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ হিসেবে উপস্থাপনকে ভোটাররা সহজভাবে মেনে নিয়েছেন। মমতার এই সহজাত ক্ষমতাকেই অনেকে তাঁর ‘কারিশমা’ বলে থাকেন। যেমনটা বলে গেছেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।