অনলাইন ডেস্ক:
বর্ণিল আয়োজনে বাঙালি জাতির ইতিহাসের দুই মাহেন্দ্রক্ষণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা শুরু করেছে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার বিকেলে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের এই বিশেষ অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ ও ফার্স্ট লেডি ফাজনা আহমেদ। শুরুতেই নজর কাড়ে শত শিশুশিল্পীর সংগীত পরিবেশনা।
অনুষ্ঠানস্থলে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, রাষ্ট্রপতির স্ত্রী রাশিদা খানম এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত এক বছর থমকে গিয়েছিল সব আয়োজন; বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন এক বছর ধরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল, তার মাঝেই বাঙালির জীবনে এসেছে উদযাপনের আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এ দুই বিশেষ উপলক্ষ ঘিরে গতকাল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শুরু হলো ‘মুজিব চিরন্তন’। আগামী ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিনে এটি শেষ হবে।
গতকালের অনুষ্ঠানের থিম ছিল ‘ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়’। বিকেল সাড়ে ৪টায় শিশুশিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর শত শিশুশিল্পীর কণ্ঠে পরিবেশিত হয় সংগীত। আমন্ত্রিত অতিথিদের মঞ্চে আসন গ্রহণের পর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে শোনানো হয়। এরপর একে একে মুজিব চিরন্তন থিমের ওপর টাইটেল এনিমেশন ভিডিও পরিবেশনা, থিম সংয়ের মিউজিক ভিডিও পরিবেশনা, ফ্লাই পাস্টের রেকর্ডকৃত ভিডিও প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ধারণ করা ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে চীনের উপহারস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য প্রদানের ভিডিও প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থেকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্য দেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর অতিথিদের ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধা স্মারক প্রদান করা হয়। সব শেষে অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা পর্ব শেষ হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুরুতেই ছিল বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের নৃত্যশিল্পীদের সরাসরি নৃত্যানুষ্ঠান। এরপর মুজিব চিরন্তন থিমের ওপর টাইটেল এনিমেশন ভিডিও, থিমভিত্তিক এনিমেশন ভিডিও, মুজিব শতবর্ষের কার্যক্রম ফিরে দেখার ওপর ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এরপর চারটি সঞ্চালনা ড্রামা পরিবেশন করা হয়। এগুলো হচ্ছে—থিমেটিক অডিও ভিজ্যুয়াল (ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়), বাদ্যযন্ত্র সহযোগে অর্কেস্ট্রা মিউজিকের সঙ্গে গান পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধুকে প্রতীকী চিঠি উৎসর্গ ও জয়ঢাক সহযোগে বিশেষ পরিবেশনা। সব শেষে ছিল ফায়ার ও লেজার শো।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছি। এ সময়ে রাজনীতিতে অনেক চড়াই-উতরাই ঘটেছে। কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়—এটাই হচ্ছে রাজনীতির মূল আদর্শ। কিন্তু আজকাল যেন রাজনীতি উল্টো পথে হাঁটছে।’
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দুয়ারে দাঁড়ানো বাংলাদেশে রাজনীতির গতিধারা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে রাজনীতিবিদদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ফেরার এবং দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘কিছু সুবিধাবাদী লোক রাজনীতিটাকে পেশা বানিয়ে ফেলেছেন। রাজনীতি আর পেশা এক জিনিস নয়। পেশার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। আর রাজনীতি হচ্ছে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার একটি মহান ক্ষেত্র। তাই রাজনীতিকে পেশা মনে করলে দেশ ও জনগণের কথা ভুলে নিজের ও পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করে দেশকে এগিয়ে নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি এখনো দেশে-বিদেশে সক্রিয় রয়েছে। তারা নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে আমাদের অর্জনকে নস্যাৎ করতে চায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শুভ জন্মদিনে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সব অপতৎপরতা প্রতিহত করে প্রিয় মাতৃভূমিকে উন্নয়ন-অগ্রগতির পথ ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সুবর্ণ জয়ন্তীর দুয়ারে দাঁড়ানো বাংলাদেশের সামনে সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি। আমাদের পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ আর নেই। এখন শুধু আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এ দেশকে আমরা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবই, ইনশাআল্লাহ। এটাই আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন যে অবস্থানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে তাকে সহজে নামানো যাবে না। বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মহামারিও সফলভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে। এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। ভিডিও বার্তায় তিনি মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে চীনের জনগণ ও সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান।
শি চিনপিং বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের জনগণের পুরনো ও ভালো বন্ধু ছিলেন। ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে দুবার চীন সফরে তিনি চেয়ারম্যান মাও জেদং ও প্রিমিয়ার চৌ এনলাইর এবং পুরনো প্রজন্মের অন্য চীনা নেতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন।’
চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, “চীনে একটি কথা আছে, ‘যারা কূপ খনন করেছে, পানি পানের সময় তাদের কথা ভুলে যেয়ো না।’ আমাদের পুরনো প্রজন্মের নেতারা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রসারে যা করেছেন, তা আমরা অবশ্যই মনে রাখব এবং চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের সেই ‘ব্যাটন’ (লাঠি) পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেব।”
প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ সহযোগিতাবিষয়ক আন্ত সরকার দলিলে সই করেছে। ব্যাবহারিক সহযোগিতা দুই দেশের জনগণেরই সত্যিকারের উপকারে আসছে।”
অন্যদিকে মালদ্বীপের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশি কর্মীদের অবদান পরিমাপ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন ওই দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রবাসী কর্মীদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের আগ্রহের কথা জানান। তিনি বলেন, মালদ্বীপে বিদেশি জনশক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে বাংলাদেশিরা।
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলেন, বঙ্গবন্ধু আগামী অনেক প্রজন্মের কাছেই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম মহান নেতা এবং তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
প্রেসিডেন্ট সলিহ বলেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে আপসহীন ছিলেন। ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সেই ভাষণ ইউনেসকোর বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে তাদের সবার হৃদয়ে সব সময় সম্মানের আসনে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভিডিও বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা উদযাপন করছে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নেই সম্ভব হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নিজের জীবন দেশের জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে ট্রুডো বলেন, ‘আমি যখন প্রথমবার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশ সফর করি সে সময়ের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গত ৫০ বছরে এ দেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির মতো বিষয়গুলো এ দেশের মানুষের সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আর এ পথচলার প্রতিটি পদক্ষেপে কানাডা সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে আছে।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগাও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের পাশে আছে জাপান। তিনি বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যে ভাই-ভাই সম্পর্ক বলেও মন্তব্য করেন।