বাংলাদেশের আন্ত সীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকবর্জ্য বহন করে। এর মধ্যে দুই হাজার ৫১৯ টন ভারত ও ২৮৪ টন মিয়ানমার থেকে আসে। প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে আনুমানিক ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৯ টন। বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) দ্য ট্র্যাজিক টেলস অব আওয়ার রিভারস : প্রসপেক্ট টু প্রবলেম’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নদী ও সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া প্লাস্টিক দূষণ মানুষ, পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই সকলে’ প্রতিপাদ্যে আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩ পালিত হচ্ছে।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘এই গবেষণার সাহায্যে আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি যে আন্তর্দেশীয় নদীগুলোতে প্রতিদিন কী পরিমাণ একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক এসে জমা হয়। আমরা দেখেছি, এই নদীগুলোতে আমাদের দেশের বাইরে থেকে মূলত ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য আসে।
গবেষণায় বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের (সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক) পরিমাণ বের করতে পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, নাফসহ ১৭টি আন্ত সীমান্ত নদী ও বঙ্গোপসাগরের ২৬টি পয়েন্ট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। গত বছরের আগস্টে গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের আন্ত সীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ৩৪৫ টন একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য বহন করে। এর মধ্যে দুই হাজার ৮০২ টন ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসে, দুই হাজার ৫১৯ টন ভারত ও ২৮৪ টন মিয়ানমার থেকে।
আনুমানিক ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৯ টন (২.৬ মিলিয়ন টন) একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। যার মধ্যে আন্ত সীমান্ত বর্জ্য রয়েছে চার লাখ ৭০ হাজার ৪৩৯ টন (প্রায় অর্ধমিলিয়ন টন)। ভারত থেকে চার লাখ তিন হাজার ৩২৭ টন ও মিয়ানমার থেকে বছরে ৬৭ হাজার ১১২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রবেশ করে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারসংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়।
সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ দশম স্থানে। বাংলাদেশে খাদ্য এবং ব্যক্তিগত সামগ্রীর মোড়ক একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ১৪ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এগুলো প্রায়ই নদী ও সমুদ্রে গিয়ে মেশে। এসডো জানায়, প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা সত্ত্বেও দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর তলদেশ ও পাড়ের মাটিতে কী পরিমাণ প্লাস্টিক আছে তা দেখার জন্য এই চারটি নদীর মাটি খনন করে এক মাস ধরে গবেষণা চালাচ্ছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আমরা যতটা আশা করেছি তার চেয়ে বেশি প্লাস্টিক পাচ্ছি মাটির নিচে। বেশির ভাগই মূলত প্লাস্টিকের মোড়ক। কিছু কিছু মোড়কের গায়ে আমরা উৎপাদনের তারিখও পেয়েছি। ২০১০ সালের মোড়কও পেয়েছি।’
২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘টুয়ার্ডস এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ নামক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল তিন কেজি। ২০২০ সালে তা বেড়ে ৯ কেজি হয়। ঢাকায় বছরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার আরো বেশি, ২২.৫ কেজি।
প্রতিদিন সিটি করপোরেশন ছয় হাজার ৪৬৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে। এর ১০ শতাংশই প্লাস্টিক। প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যার ১২ শতাংশ খাল ও নদীতে এবং ৩ শতাংশ ড্রেনে ফেলা হয়; যা নদীব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত।
প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ এবং ধরন বোঝার জন্য বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে তাদের জরিপটি পরিচালনা করে।
প্লাস্টিক ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ:
বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। ২০২০ সালে উপকূলীয় অঞ্চল এবং সারা দেশে সব হোটেল ও মোটেলগুলোতে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ জারি করা হয়েছিল।
ঝুঁকি ও করণীয়
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, সমুদ্রে ও নদীতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক জলজ প্রাণী ও মাছ খায়। পরে সেটা হয়তো আমরাও খাচ্ছি কোনো না কোনোভাবে। আবার প্লাস্টিক বা পলিথিন যখন মাটিতে যাচ্ছে তখন সেটা মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে। নদীর তলদেশে প্লাস্টিক জমার কারণে পানির উচ্চতা বেড়ে বন্যার ভয়াবহতা বাড়তে পারে। তবে সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিটা পৃথিবী খুব বেশি অনুধাবন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ফলে সামুদ্রিক মাছ বা প্রাণীর ওপর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সামুদ্রিক প্রাণী পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘মাইক্রো প্লাস্টিক অত্যন্ত ভয়ংকর। কারণ এটা পানি, জলজ প্রাণী ও মাছের মধ্যে আমাদের দেহেও চলে। নারীর ভ্রূণেও প্লাস্টিকের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এটা মানুষের রক্ত, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কে ব্লক তৈরি করছে।’