অনলাইন ডেস্কঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেলখানায় প্রথম আমার সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৮ জুন। আমি আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের কর্মী কখনোই ছিলাম না। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ‘ছয় দফা ন্যায্য দাবি; কিন্তু বাঙালির মুক্তির সনদ নয়’। তাই ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে আমাদের প্রতি জনতার সঙ্গে থাকার নির্দেশনা ছিল। সেই হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম এবং এক মাসের জেল হয়েছিল। পরের দিন যখন কয়েদিদের ‘কেস টেবিলে’ আমাদের আনা হয়েছে, তখন কেস টেবিলের চত্বরের পাশে ‘দেওয়ানি এলাকায়’ প্রবেশের দরজা খুলে ভেতর থেকে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা একজন মানুষ আমাদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। তখন আশপাশের হাজতিরা বলল, এটাই শেখ মুজিব। তাঁকে এই আমার প্রথম স্বচক্ষে দেখার ঘটনা।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল স্বাধীনতার পরে। আমি ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) ভিপি (সহসভাপতি) নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরো নিবিড় হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলন উদ্বোধন করার পর আমি স্লোগান দিলাম, ছাত্র ইউনিয়ন জিন্দাবাদ, জয় সমাজতন্ত্র। তখন তিনি কানে কানে আমাকে বললেন, ‘দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ এখনো শেষ হয়নি। জয় বাংলা স্লোগানটা একটু দাও।’ তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বসে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেগুলো সব সময় রাজনৈতিক আলাপ ছিল না। আমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি মন্তব্য করতেন। জানতে চাইতেন কী কাজ করছি, কেমন করে করছি। হয়তো কখনো তিনিও নিজের কাজ সম্পর্কে বলতেন যে ‘সেলিম, আজ এ কাজটি করে আসলাম।’ আমিও কিছু বিষয় তাঁর সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমি বয়সে ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সন্তানতুল্য, অনেক জুনিয়র একজন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী। আমি ভিন্ন দল করতাম। এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। আমি নিজেও সচেতন ছিলাম। এ কারণে কখনো সম্পর্কটা গুরু-শিষ্যের মতো ছিল না।
স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু ভুলত্রুটি যে করেননি, তা নয়। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক ‘শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা’ সত্ত্বেও তিনি ‘জনগণের মানুষ’ ছিলেন। তাঁর মাঝে অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টি ছিল। একটি আলোচনার কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘মোশতাক (খন্দকার মোশতাক আহমদ) সম্পর্কে সাবধানে থাকবা। ওর মাথার ভেতরে খালি প্যাঁচ। মাথায় একটা তারকাঁটা ঢোকালে দেখবা ওইটা বাইর করার সময় স্ক্রু হয়ে গেছে!’ আমি বললাম, ‘আপনি তাহলে তাকে এত কাছে কাছে রাখেন ক্যান?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কাছে কাছে রাখি যাতে দুষ্টামি না করতে পারে। চোখে চোখে রাখতে হয়। মোশতাক আমাকে কালকে কী বলেছে জানো? বলেছে, এত সমাজতন্ত্র কইরো না, এত ধর্মনিরপেক্ষতা কইরো না। একটু আল্লাহ আল্লাহ করো, ব্যক্তি খাতকে গুরুত্ব দেও। ওকে আমি বলে দিছি—মোশতাক তোর কথা আমি শুনলাম না। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র নিয়ে, জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে—আমি সমাজতন্ত্রের পথেই যাব, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই যাব।’
এই মোশতাক গং এবং অন্যরা বঙ্গবন্ধুকে এই অবস্থান ও পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে আপস এবং কনসেশন (সম্মতি) আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এ কথাটি বুঝেছিল যে তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) সম্পূর্ণভাবে ‘সরিয়ে দিতে’ না পারলে দেশকে সম্পূর্ণ ‘অ্যাবাউট টার্ন’ করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল লক্ষ্য এবং কাঠামোর বাইরে নিয়ে আসা যাবে না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংগঠিত সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সবচেয়ে আগে পথে নেমেছিলাম আমরাই। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকার রাজপথে প্রথম সংগঠিত মিছিলটি আমার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গতিধারাকে বহুলাংশে উল্টে দেওয়া হয়েছিল। আজও দেশ সেই প্রতিক্রিয়াশীল ‘উল্টো পথ’ ধরেই চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে উল্টে দিতে পারলেও তার সবটুকু অর্জন নিঃশেষ করা যায়নি। এর কারণ, মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি, তেমনি তা প্রধানত ছিল জনগণের নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হলেও জনগণকে হত্যা করা যায়নি। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারা তথা চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিত্যক্ত হলেও তা নিরন্তর জাগ্রত রয়েছে কোটি মানুষের অন্তরে। ‘গণজাগরণ মঞ্চের’ উত্তাল জোয়ার সে কথার সত্যতার প্রমাণ দিয়েছে।
এ কারণে তাই এ কথাও একইভাবে বলা যায় যে কোটি মানুষের অন্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও অমর হয়ে থাকবেন। কারণ বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মিলিত কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের যেমন মৃত্যু নেই, সে কারণে বঙ্গবন্ধুরও মৃত্যু নেই।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)