ওপরের কথাগুলো আক্ষেপের সুরে সেই ব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন, যাঁকে বাংলাদেশের প্রথম সফল মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়। বর্তমানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক সাহেব ৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের বেশ কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ১৯ মার্চ তারিখে খুবই হালকা কিছু অস্ত্র এবং অপ্রশিক্ষিত কিছু নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে নিয়ে অতি সুসজ্জিত, সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারকে পরাস্ত করে, ভাওয়াল এলাকা থেকে বিতাড়িত করে রেকর্ড গড়েছেন, যে কথা আমি সেই সময়ে লন্ডনে অবস্থানকালে পত্র-পত্রিকায় পড়েছি।
গত ১৮ মার্চ ৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক শাহরিয়ার কবিরের লেখা ‘আমার ৭১’ বইয়ের ওপর প্রধান অতিথির ভাষণে মন্ত্রী মহোদয় এ কথা বলেন। বাংলা একাডেমির একটি মিলনায়তনে সেই আলোচনাসভার আয়োজন করেন গণহত্যা জাদুঘরের প্রধান ট্রাস্টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের ধারক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় আক্ষেপ ছিল, ছিল সুপ্ত বেদনা এবং গভীর আবেগ। তাঁর ভাষণে যে চরম বাস্তবতার প্রতিফলন রয়েছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। মনে হচ্ছে দেশটি তাদেরই, আমরা কিছু পাগল-ছাগল তাদের পথের কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছি।
এর সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহিন ও তাঁর স্ত্রীর লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদ্বয় এনায়েতুর রহিম ও নুরুজ্জামান ননি, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন এবং বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরাও একই ধরনের কথা প্রকাশ্যে খোলামেলা ভাষায় প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাস্তবধর্মী ভাষণ জানান দিচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুগত মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিরাজ করারই কথা। একাত্তরে তাঁরা তো কল্পনাও করতে পারেননি যে ওই বছরের পরাজিত ধর্মান্ধ অপশক্তি আবার নতুন করে উদিত হবে, ডানা মেলে উড়তে শুরু করবে।
জিয়া-পরবর্তী সময়ে এরশাদ ও খালেদা জিয়াও তাদের শক্তি আরো বর্ধিত করেছেন বিভিন্নভাবে। মূলত তাঁদের পাকিস্তানি প্রভুদের নির্দেশ ও পরামর্শে। পঁচাত্তরের পর দেশটি পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের দ্বিতীয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল।
অধ্যাপক মামুন সব সময় বলে থাকেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারে পরিবর্তিত হয়েছে এমন নজির অনেক আছে, কিন্তু কোনো রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়নি।’ দেশে সর্বাধিকসংখ্যক পুস্তকের লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে নিরলস গবেষক মুনতাসীর মামুনের কথাগুলো তাঁর গবেষণারই ফল। একাত্তর সালে নিশ্চিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমন ব্যক্তি যখন কুখ্যাত রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, তাঁর বিচারকালে তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে যান, তখন মামুন সাহেবের দাবির নিরঙ্কুশ বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। যে ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তিনি যখন পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের ২৫ ও ২৬ মার্চের ভূমিকার ওপর সত্যের অপলাপ ঘটিয়ে কথা বলেন, তখন মামুন সাহেবের উক্তি প্রমাণে আর কী লাগে। আরেক মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল, যিনি একাত্তরে ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তিনি যখন সেই ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদীদের গুণকীর্তন করেন, তাহলে মামুন সাহেবের যুক্তি খণ্ডন করা অসম্ভব হয়ে যায় বৈকি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক অত্যন্ত স্পষ্টবাদী একজন মানুষ, যিনি রাখঢাক না রেখেই কথা বলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন অনেক কথা বলাই তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা গোপনীয়তার শপথ দ্বারা তিনি বাধিত। প্রশ্ন থেকে যায় এই পাকিস্তানি চর অপশক্তির ডানা কিভাবে কাটা যাবে?
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি