পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের রুক্ষ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটিকে এক নজরে দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না যে কয়েক দশক আগে পর্যন্তও এটাই ছিল পর্যটকদের কাছে ইউরোপ থেকে স্থলপথে পাকিস্তান আসার প্রধান পথ। রাস্তাটার নাম ‘লন্ডন রোড’। বিবিসি নিউজ উর্দুর সেহের বালোচ নিজে বেলুচিস্তানের নোশকি জেলা লাগোয়া ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছেন এই রাস্তা দিয়েই। কিন্তু রাস্তাটার ইতিহাস তার অজানা ছিল।
হানিফি তার বইতে লিখেছেন, বেলুচিস্তান অঞ্চল সম্পর্কে অনেকেই কিছু জানত না। কারণ জায়গাটি বহু শতাব্দী ধরে কোনো দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে ছিল না।
হানিফির লেখা অনুযায়ী, যে দুজন গুপ্তচরকে বেলুচিস্তানে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট হেনরি পটিঙ্গার ও চার্লস ক্রিস্টি। পটিঙ্গার ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বেলুচিস্তানে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ইরান ও তারপর তুরস্ক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মনে করা হয়, সেই প্রথমবার কেউ ভারত থেকে বেলুচিস্তান, ইরান হয়ে অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
লন্ডন রোডে চলত দোতলা বাস
বেলুচিস্তানের সাবেক প্রধান সচিব আহমেদ বকশ লাহোরি জানান, ব্রিটিশ আমলের আগে মোগল জামানায় এই লন্ডন রোডকে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হতো। মোগল ও ব্রিটিশরা এই রাস্তাটি প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করলেও, ভারত ভাগের পরবর্তী দশকগুলোতে ইউরোপ ও পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে এই রাস্তাটি। আগে যে রাস্তায় ঘোড়া চলত, সেখানেই শুরু হলো বাস আর মোটরসাইকেলে চেপে লন্ডন থেকে কোয়েটা পর্যন্ত যাত্রা।
এই প্রতিবেদনের জন্য গবেষণার সময় সেহের বালোচ ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তোলা বেশ কিছু পুরনো ছবি খুঁজে পান। এগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে কোয়েটার কাছে লন্ডন রোডের ওপরে বেশ কয়েকটি মাইলস্টোনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ পর্যটকদের ছবি, তেমনই রয়েছে দোতলা বাসের একটি ছবি আর তার যাত্রীরা রাস্তার ধারে পিকনিক করছিলেন।
গবেষক ইয়ারজান বাদিনি এই ছবিগুলো যাচাই করে দেখেছেন। তিনি বলেন, সেই সময়ে ইউরোপের দেশগুলো থেকে মানুষ বাসে করে কোয়েটায় যেতেন এবং সেখান থেকে ভারতের দিকে রওনা হতেন তারা।

পথের ধারে হোটেল, সরাইখানা
এই সড়কে যাতায়াতের পথে অনেক সরাইখানা ও চায়ের দোকানও দেখা যায়। ইয়ারজান বাদিনি জানান, ওইসব সরাইখানা তীর্থযাত্রী বা সাধারণ যাত্রীদের জন্য গড়ে উঠেছিল। এরকমই একটা চায়ের দোকান বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে চালু করেন তাজ মোহাম্মদ। তার ছেলে মুমতাজ আহমেদ বলেন, প্রথমে সেটি ছিল একটি সরাইখানা। সেখানে যাত্রীদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা ছিল। তবে ১৯৯৯ সালে তার বাবার মৃত্যুর পরে সেটি একটি চায়ের দোকানে রূপান্তরিত করা হয়।
তার কথায়, ‘এখন বেশি লোক আসে না। কারণ বেশির ভাগ মানুষ বিমানে চেপেই ভ্রমণ করেন। কিছু মোটরসাইকেল আরোহী আসেন, যারা শুধু চা-ই পান করেন।’
সেখানেই সেহের বালচের সঙ্গে আশফাক নামের এক শিক্ষকের দেখা হয়। এই রাস্তা নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। তিনি বলেন, এই রাস্তাটিকে এন৪০ও বলা হয়। এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব হলো কোয়েটা থেকে ফল, শাকসবজি ও অন্যান্য সামগ্রী এই লন্ডন রোড দিয়েই ইরানে যায়।
আশফাক বলেন, ‘ছোটবেলায় বহুবার দেখেছি, ডাবল ডেকার বাসে চড়ে ব্রিটিশরা কোয়েটায় আসত। আমার মা-বাবা ইংরেজি ভাষা জানতেন না, কিন্তু তারা ইশারা দিয়ে বুঝিয়েই তাদের আমন্ত্রণ জানাতেন আমাদের বাড়িতে।’
এই রাস্তা দিয়ে কোয়েটা যাওয়ার পথে যে হোটেলগুলো তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল লোডজ ও ব্লুমস্টার হোটেল। আরো কয়েকটি ছোট হোটেলও ছিল। লোডজ হোটেলটি ফিরোজ মেহতা নামের এক পার্শি চালু করেছিলেন ১৯৩৫ সালে। এক সময় ওই হোটেলে বিদেশিদের ভিড় থাকত। কিন্তু এখন সেনা ছাউনির সীমানার মধ্যে পড়ে যাওয়ায় ওখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। তাই পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।
লোডজের মালিকও আর পাকিস্তানে থাকেন না। হোটেলটির দেখাশোনা করেযেডার নামের এক ম্যানেজার। তিনি কথা বলতে চাইছিলেন না। তবে অন্যদিকে ব্লুমস্টার হোটেলের মালিক ফাহিম খান বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানান, বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে তার বাবা এই হোটেলটি চালু করেছিলেন।
তার কথায়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা তার হোটেলে আসতেন এবং এখনো তাদের নাম, দেশের নাম এসব রেজিস্টারে রাখা আছে।
তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল, যখন এখানে পা ফেলার জায়গা থাকত না। মানুষ কোনো না কোনোভাবে চলে আসত এখানে।’
নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত পর্যটকরা
নিরাপত্তা তল্লাশির কারণে পর্যটকদের সমস্যায় পড়তে হয় উল্লেখ করে ফাহিম খান আরো বলেন, ‘যদি কেউ ইউরোপ থেকে এখানে আসেন, তাকে সব জায়গায় ছাড়পত্র দেখাতে হয় অথবা ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে হয়। মানুষ বিরক্ত হয়ে যান এর ফলে। এই কারণে অনেক ইউরোপীয় পাকিস্তানে তিন-চার দিন থাকেন, অথচ ভারতে মাস ছয়েকও থেকে যান।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে ইউরোপ থেকে পর্যটকদের সংখ্যা কমে যায়। একই সঙ্গে অবৈধভাবে বিদেশে যাতায়াতকারীদের সহজ রুট হিসেবে কুখ্যাত হয়ে ওঠে এই সড়কপথ।
এ রকম অনেক ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে মানব পাচারকারীরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে পাকিস্তানি যুবকদের ইরান ও তারপর তুরস্ক হয়ে এই রাস্তা দিয়েই ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। পরে ওই সব দেশের সীমান্ত পুলিশের হাতে এই যুবকরা হয় ধরা পড়ে বা গুলিতে প্রাণ হারায়। কিন্তু রাস্তাটির নাম ‘ডাংকি রুট’ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, এই সড়কটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই লন্ডন রোড দিয়ে যেতে চাওয়া পর্যটকেরও অভাব নেই।
দুই মাস ধরে লন্ডন থেকে পাকিস্তান সফর
কোয়েটার বাসিন্দা ফটোগ্রাফার দানিয়াল শাহর বহু বছর ধরে ইচ্ছা ছিল এই রাস্তা দিয়ে ভ্রমণ করার। তিনি নিজের সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তিনি এখন বেলজিয়ামে পড়াশোনা করছেন। বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে শাহ বলেন, এই রাস্তা পেরোতে তার দুই মাস সময় লাগে।
কথা বলার সময়ে তিনি রাস্তাটির নাম ‘ডাংকি রুট’ বলেই উল্লেখ করছিলেন। তিনি এ-ও বলেন, অবৈধ অভিবাসীরা যেহেতু এই রাস্তা বেশি ব্যবহার করেন, তাই ইউরোপের কয়েকটি দেশের নিরাপত্তা চেকপোস্টে তাকে বাড়তি সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘যাত্রা শুরু করার পরই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এই রাস্তা দিয়ে একজন পাকিস্তানি ও একজন ব্রিটিশ পর্যটকের ভ্রমণের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। নিরাপত্তা চেকপোস্টে আমাকে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আগতদের মোকাবেলা করতে হয় না।’
একটি উদাহরণ দিয়ে দানিয়াল শাহ বলেন, ক্রোয়েশিয়ায় তাকে অন্য যাত্রীদের থেকে আলাদা করা হয় এবং বেশ দুর্ব্যবহার করা হয়। এর একটাই কারণ, এই রাস্তাটি অবৈধ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এমনকি যারা পাকিস্তানে পৌঁছন, সেখানেও তাদের পিছু নেন নিরাপত্তাকর্মীরা। এর ফলে এই রাস্তা দিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা কিছুটা যেন তিক্ত হয়ে যায়।
দানিয়াল শাহ বলেন, ‘কিন্তু কী করা যাবে! ইউরোপীয় পর্যটকদের নিরাপত্তাটাও তো গুরুত্বপূর্ণ।’
সূত্রঃ বিবিসি