অনলাইন ডেস্ক:
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় গত বছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ ঘরে বসে উপভোগ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সরকার ঘোষিত সব ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে এই অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলা নববর্ষ (১৪২৮) শুরুর আগের দিন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, সরকার আপনাদের পাশে রয়েছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকার চিকিৎসা সুবিধা বাড়াচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো এই ভাষণ একযোগে সম্প্রচার করে। রেকর্ড করা ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নববর্ষের চিরায়ত দৃশ্যসংবলিত মনোরম সবুজ এক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ১৩ মিনিটের ভাষণে তিনি বাঙালির সবচেয়ে বড় এই উৎসবে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান এবং সব মানুষের জীবন যাতে বর্ণিল ও আনন্দময় হয়ে ওঠে সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
করোনা মহামারির ভয়াবহতা ঠেকাতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে দ্বিতীয় ঢেউ প্রবল আকার ধারণ করলে মানুষের চলাচলের ওপর আমাদের কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়। কিন্তু কোনোভাবেই সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। অনেকেরই জীবন-জীবিকায় অসুবিধা হবে। কিন্তু সবার আগে মানুষের জীবন।’ গত বছরের মতো এবারও ঘরে বসে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছরের মতো এ বছরও আমরা বাইরে কোনো অনুষ্ঠান করতে পারছি না। কারণ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ নতুন করে আঘাত হেনেছে সারা দেশে। পহেলা বৈশাখের আনন্দ তাই গত বছরের মতো এবারও ঘরে বসেই উপভোগ করব আমরা। টেলিভিশন চ্যানেলসহ নানা ডিজিটাল মাধ্যমে অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হবে। সেসব অনুষ্ঠান উপভোগ ছাড়াও আমরা নিজেরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে আনন্দ উপভোগ করতে পারি।’ তিনি বাংলা নতুন বছরে অতীতের সব জঞ্জাল-গ্লানি ধুয়ে-মুছে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে সামনের দিকে যাওয়ার শপথ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ দেশে বাংলা নববর্ষ পালনের গুরুত্ব ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রামগঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুষঙ্গ। ষাটের দশকের শেষ ভাগে ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। আশির দশকে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। মূলত আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলোর কর্মী-সমর্থকদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় আজকের এই অবস্থান। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছর আমরা একটানা ৬২ দিন সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। আমরা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারিনি। বিদেশের সঙ্গে চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এই অবস্থা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের যেখানেই এই মরণঘাতী ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে, সেখানেই এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। টিকা নেওয়ার পরও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, টিকা দিলেই একজন সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত হবেন এমন নিশ্চয়তা নেই বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। কাজেই টিকা নেওয়ার পরও আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’ পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, টিকা উৎপাদনের শুরুতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকার ডোজ আমরা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। এরই মধ্যে ৫৬ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। যাঁরা প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন তাঁদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় আনা হবে। আমাদের সে প্রস্তুতি রয়েছে।’
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকার চিকিৎসা সুবিধা বাড়াচ্ছে : করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকার চিকিৎসা সুবিধা বাড়াচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলায় করোনাভাইরাস রোগীর চিকিৎসা সুবিধার আওতা আরো বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইসিইউ সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে।’
শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই, সরকার জনগণের পাশে রয়েছে : করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, মানুষের জীবন-জীবিকা যাতে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে না পড়ে সেদিকে সরকার কঠোর দৃষ্টি রাখছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সবাইকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সব সময় আপনাদের পাশে রয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আমি দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষের সহায়তার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি।’
করোনায় অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সরকার চার মূলনীতি সামনে রেখে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় গত বছর আমরা চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করেছিলাম। চারটি কার্যক্রম হচ্ছে : (১) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা : সরকরি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কমসৃজনকেই’ প্রাধান্য দেওয়া; (২) আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন : অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা; (৩) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি : দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি; এবং (৪) মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা : অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।