ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিষ্ঠার ২ বছরের মধ্যেই ৮৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” নামে একটি সামাজিক সংগঠন। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে পরিচয়হীন কোন লাশ এলেই ডাক পড়ে বাতিঘর সদস্যদের।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করা “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এখন পর্যন্ত ৮৭ জনের মতো ‘পরিচয়হীন’ ও ‘স্বজনহীন’ লাশ দাফনকাজ সম্পন্ন করেছে। “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এখন পরিচয়হীন ও স্বজনহীন লাশ দাফনে শেষ ঠিকানা। এছাড়াও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া একাধিক ব্যক্তির লাশ দাফনেও সহায়তা করেছেন “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এর সদস্যরা।
“ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এর কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনায় আক্রান্তদের লাশ দাফনে সহায়তা করতে তারা “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” নামে একটি সামাজিক সংগঠন গঠন করে। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
দৈনিক যায়যায় কাল পত্রিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ও অ্যামুলেট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার মো. আজহার উদ্দিন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও চিকিৎসক রয়েছেন সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে। পরিচয়হীন লাশ পাওয়া গেলে এর দাফনকাজ সম্পন্ন করা হলো সংগঠনটির প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়া কেউ স্বজনহীন কিংবা অসহায় হলেও দাফন কাজে সহায়তা করেন তাঁরা।
পৌর এলাকার মেড্ডা তিতাস নদীর পাড়ে লাশ দাফন করা হয়। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরামপুর থেকে উদ্ধার হওয়া বৃদ্ধার লাশের দাফন করেন “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এর সদস্যরা।
সংগঠনের সদস্যরা জানান, মূলত ট্রেনে কাটা পড়ে ও ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ককে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লাশগুলোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেওয়ারিশ হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে বৃদ্ধ/বৃদ্ধা ও নবজাতকের লাশও পাওয়া যায়।
হাসপাতাল সূত্র, পুলিশ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে খবর পেয়ে “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এর সদস্যরা লাশ দাফনের কাজে এগিয়ে আসেন। বেওয়ারিশ লাশ এলেই হাসপাতালের মর্গ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘরকে আহ্বান জানান দাফন কাজ করে দেওয়ার জন্য। তখন “ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” এর সদস্যরা ধর্মীয় বিধি মেনে জানাজা পড়িয়ে তাদের লাশ দাফনকাজ সম্পন্ন করে।
“ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর” সদস্য মো. রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমি জানাযার নামায পড়ার দায়িত্বে থাকি। অন্য সদস্যরা করব খোঁড়ারসহ কাফন-দাফনের দায়িত্ব পালন করেন। এমন কাজ করতে পেরে আমার খুবই ভালো লাগে। যত ব্যস্তই থাকি চেষ্টা করি দাফনকাজে উপস্থিত থাকতে। সম্ভব না হলে অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে কাজটা করিয়ে দেই।
বাতিঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. আজহার উদ্দিন বলেন, মূলত করোনায় মৃতদেহ ও বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্যই বাতিঘরের প্রতিষ্ঠা। করোনাকালীন সময় করোনায় মৃতদের দাফনে স্বজনদেরকে বেগ পেতে হতো। দাফনের জন্য লোক পাওয়া যেতো না। তখন আমরা এগিয়ে আসি। এখন নিয়মিত বেওয়ারিশ লাশ দাফনকাজ করি আমরা। তিনি বলেন গত ২ বছরে আমরা ৮৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফনকাজ সম্পন্ন করেছি।
তিনি বলেন, লাশ দাফনে সরকারিভাবেও বরাদ্দ থাকে। কিন্তু আমরা সেদিকে তাকিয়ে থাকি না। নিজেদের টাকায় সব কিনে ফেলি। আমার আয়ের টাকা এখানে ব্যয় করা হয়। কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে ফেলা হয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র কাফনের কাপড় বাশ-দাড়িসহ অন্য সব কেনা হয়। এ জন্য আলাদা আলাদা টিম রয়েছে। কেউ কবর খুড়বে, কেউ কাপড় কিনবে, কেউবা লাশ নেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিবে, কেউ দাফনকাজে সহায়তা করবে। জানাজা পড়ানোর জন্যও একজনকে রাখা হয়েছে। আগে দিন রাতের যেকোনো সময় লাশ দাফনের কাজ করা হতো। তবে বিভিন্ন কারণে এখন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে লাশ দাফন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বেওয়ারিশ লাশ দাফনকাজের পাশাপাশি বিনামূল্যে রক্তদান ও অক্সিজেন সেবা সহ অসহায়দের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করি।
এ ব্যাপারে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গের ইনচার্জ মো. সুমন ভূইয়া বলেন, ২-৩ বছর আগে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে পরিচয়হীন লাশের দাফন কাজ করা হতো। কিন্তু একটি সমস্যার কারণে সংগঠনটি এখন আর কাজ করছে না। এ অবস্থায় বাতিঘর এর মাধ্যমে লাশ দাফনের কাজ করা হচ্ছে। বাতিঘরের সদস্যরা খুব ভাল কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. ফাইজুর রহমান ফয়েজ বলেন, আগে হাসপাতালে আসা পরিচয়হীন লাশ দাফনে প্রায় সময়ই নানা সমস্যা দেখা দিতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। পরিচয়হীন লাশের খবর পেলেই ছুটে আসেন বাতিঘরের সদস্যরা। বাতিঘরের উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। হাসপাতালের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতার চেষ্টা থাকবে।